বরিশালে ভিখারির বাড়িতে ৭ বস্তায় টাকা, ১০১ শাড়ি, ২০০ লাক্স সাবান
আলেয়া বেগমকে এলাকার সবাই চেনে ‘তেল বুড়ি’ নামে। সেই তেল বুড়ির কাজ ছিল ভিক্ষা করা। আর নেশা ছিল টাকা জমানো। তেল বুড়ির খুপরি ঘরে সাতটি বস্তায় মিলেছে টাকা!
ছয়জন মানুষ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গুনেছে এসব টাকা। টাকার পরিমাণ ছিল ৯৭ হাজার ২২১। কেবল টাকা নয়, তেল বুড়ির খুপরি ঘরে পাওয়া গেছে ১০১টি নতুন শাড়ি ও ২০০টি লাক্স সাবান। আর চাল পাওয়া গেছে এক মণ।
গতকাল বুধবার বরিশাল নগরীর বটতলা এলাকার আদম আলী হাজি গলিতে এ ঘটনা ঘটে। আলেয়া নগরীর আদম আলী হাজি গলিতে বাবুল মিয়ার খুপরি ঘরে ভাড়ায় থাকতেন। গ্রামের বাড়ি বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরাদীতে। আলেয়ার স্বামীর নাম মোক্তার হোসেন। তিনি মারা গেছেন বহু আগেই।
গত সোমবার ৭০ বছরের বেশি বয়স্ক আলেয়া ওরফে তেল বুড়ি মারা যান নিজের ঘরেই। স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁকে মৃত অবস্থায় পান। তাঁর নিকটাত্মীয় তৈয়ব আলী লাশ গ্রামে নিয়ে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করেন।
যেভাবে মিলল গুপ্তধন
ঘরের মালিক বাবুল মিয়ার উপস্থিতিতে তৈয়র আলী মালামাল বাইরে আনতে গিয়ে বিপাকে পড়েন। কারণ, চালের পলিব্যাগে রাখা মালামাল কোনোভাবেই তিনি নাড়াতে পারছিলেন না।
বস্তাটি খুললে ভেতরে টাকার কয়েন বেরিয়ে আসে। ব্যস। পুরো এলাকা জানাজানি হয়ে যায়। স্থানীয়রা ঘটনাস্থলে পৌঁছে টাকা উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়। চালের একটি পলিথিনের বস্তা সবচেয়ে বেশি দুই টাকার নোট ছিল। পাটের রশি দিয়ে বস্তার মুখ বাঁধা ছিল। আনুমানিক দুই টাকার নোট ছিল প্রায় ৬০ হাজার টাকার। এ ছাড়া ছয়টি ছোট ছোট শপিংব্যাগে এক ও পাঁচ টাকার কয়েন ছিল প্রায় ২০ হাজার টাকার।
তবে পলিব্যাগে ১০০ টাকা মূল্যের কোনো নোট ছিল না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছয়জনে মিলে টাকা গণনা করেন।
টাকা জমানোর ঝোঁক
প্রায় এক যুগ আগে বাবুল মিয়ার ছোট খুপরি ঘর ভাড়া নেন আলেয়া। প্রথম দিকে দেড়শ টাকা মাসিক ভাড়া নির্ধারিত থাকলেও পরে তিনি আর ভাড়া দেননি। স্বামী-সন্তান নেই এমন পরিচয় দিয়ে আলেয়া ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করেন। তবে বটতলা এলাকার বাইরে তিনি কখনই যেতেন না। সবার কাছে দুই টাকা দাবি করতেন। তিনি ছিলেন অনেকটা নাছোড়বান্দা। যাকে ধরতেন, তার কাছ থেকেই টাকা আদায় করতেন। এ কারণেই তিনি বটতলায় ‘তেল বুড়ি’ হিসেবে পরিচিতি পান।
বটতলার বাসিন্দা সাইদুল ইসলাম লিমন বলেন, “প্রতিবেশী মারুফের ঘরে ‘তেল বুড়ি’ ঝিয়ের কাজ করতেন। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় ওই বাড়িতে গিয়ে থালা পরিষ্কার করতেন। বিনিময়ে তিনি তিনবেলা খাবার খেতেন। এরই ফাঁকে তিনি বটতলায় ভিক্ষা করতেন। সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিন এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে যেতেন, ভিক্ষা চাইতেন। দোকানে দোকানে গিয়ে টাকাও ভিক্ষা করতেন। তবে টাকা খরচ করে কিছু কিনছেন বলে আমরা দেখিনি। এমনকি তিনি বিনা ভাড়ায় অটোতে যাতায়াত করতেন। ঈদের আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি নতুন শাড়ি চাইতেন। কেউ কেউ শাড়িও দিতেন। শাড়ির শখ থাকলেও বুড়ি কখনো নতুন শাড়ি পরতেন না।”
বাবুল মিয়া বলেন, ‘প্রায় এক যুগ ধরে আলেয়া আমার টিনের ঘরে ভাড়াটে হিসেবে থেকেছেন। গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরাদী ইউনিয়নের চরাদী গ্রামে। শুরুতে দেড়শ টাকা চুক্তিতে ভাড়াটে হিসেবে ঘরে উঠলেও কয়েক মাস পর ভাড়া দেওয়া বন্ধ করে দেন। কিন্তু ভিক্ষা করে জীবনযাপন করায় ভাড়ার জন্য কখনোই চাপ দিতাম না।’
বাবুল মিয়া আরো বলেন, ‘আলেয়া কখনো তাঁর ঘরে কাউকে ঢুকতে দিতেন না। সব সময়ই ঘরের দরজা বন্ধ থাকত। কিন্তু তাঁর ঘরে এত টাকা থাকতে পারে, তা আমাদের ধারণার বাইরে ছিল।’
ভিক্ষার টাকা দানে
পূর্ব বগুড়া রোড জামে মসজিদের ইমামের ছেলে সাকিব জানান, ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে জমানো টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা আলেয়ার বাড়ির সামনের একটা মসজিদে দান করা হয়েছে। ওই টাকায় মসজিদের মাইক কেনা হবে। এ ছাড়া যাঁরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টাকা গুনেছেন, তাঁদের সাত হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। বটতলা জামে মসজিদের সামনে এলাকাবাসীর উদ্যোগে আয়োজিত মাহফিলে এক হাজার টাকা দান করা হয়েছে। বাসার বকেয়া ভাড়া বাবদ তিন হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি টাকা আলেয়ার দুই ভাইকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।