খালেদা জিয়া যা বললেন
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর গুলশানের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন। বিকেল ৪টা ৪৭ মিনিটে এ সংবাদ সম্মেলন শুরু হয়। শেষ হয় ৫টা ২৭ মিনিটে। সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। তাঁর বক্তব্যের পুরো অংশে নিচে দেওয়া হলো :
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
প্রিয় সাংবাদিক ভাই ও বোনেরা,
আসসালামু আলাইকুম।
মহান স্বাধীনতার মাসে শুরুতেই আমি স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গকারী বীর শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত করেছিলেন, সেই শহীদ জিয়াউর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাপ্রিয় দেশবাসীর প্রতি জানাচ্ছি মোবারকবাদ। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সংগঠকদের স্মরণ করছি পরম শ্রদ্ধায়।
একটি শান্তিময়, সুখী-সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক স্বদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশের বীর সন্তানরা জীবন দিয়েছিলেন। অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সেই দেশ আজ গভীর সংকটে। এ সংকট রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক। আর এ সংকটের স্রষ্টা আওয়ামী লীগ এবং আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে শেখ হাসিনা। জনগণের সম্মতি ছাড়া কারসাজির মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়ে সেই ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার উদগ্র বাসনা আজ সমগ্র জাতিকে এক চরম অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে।
অনেক বিবাদ-বিসম্বাদের পর বাংলাদেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল এই মর্মে একমত হয়েছিল যে কোনো দলীয় সরকারের অধীনে এখানে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
তারই আলোকে জাতীয় সংসদে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান আমরা প্রজাতন্ত্রের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। এই ব্যবস্থার অধীনে কয়েকটি নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’-এর মধ্য দিয়ে যেকোনো পদ্ধতিই সংশোধিত ও পরিশোধিত হতে পারে।
প্রয়োগের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় পরিলক্ষিত ত্রুটি-বিচ্যুতিও ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সংশোধনের সুযোগ ছিল এবং উচিত ছিল সেটাই করা। আওয়ামী লীগ তা না করে একতরফা সিদ্ধান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। তারা দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিধান করে। এ লক্ষ্যে তারা সংবিধানের যে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করেছে তাতে শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও স্বাভাবিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সব পথই প্রায় রুদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো সুযোগই রাখা হয়নি। সংকটের মূল উৎস সেখানেই।
এই মহাবিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনীর আওতায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নামে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এক নির্লজ্জ প্রহসনের মধ্য দিয়ে তারা গণতন্ত্রের নাম-নিশানাও মুছে দিয়েছে। এই প্রহসনের অংশ হিসেবে অপকৌশলের মাধ্যমে তারা ভোট ছাড়াই সংসদের ১৫৩টি অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে নিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করে। এই ঘৃণ্য কারসাজির মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বহীন একটি অবৈধ ও স্বেচ্ছাচারী সরকার জগদ্দল পাথরের মতো জাতির কাঁধে চেপে বসেছে। জবাবদিহিতাহীন এ সরকারের দেশ পরিচালনার কোনো নৈতিক অধিকার, ভিত্তি ও এখতিয়ার নেই।
মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে এমন ন্যক্কারজনক জালিয়াতি করার পর গণতন্ত্র কিংবা জনগণের অধিকার নিয়ে কথা বলার কোনো নৈতিক অধিকারও তাদের নেই।
সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আপনারা সকলেই জানেন, ঐ মহাকারসাজির নির্বাচনী প্রহসনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে এটি একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন।
শেখ হাসিনা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে একটা সমঝোতা হলে সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের অঙ্গীকারও করেছিলেন। কিন্তু যথারীতি তিনি তাঁর সেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন। আসলে প্রতিশ্রুতি রক্ষার কোনো দৃষ্টান্ত তাঁদের নেই।
১৯৮৬ সালে প্রতিশ্রুতি লংঘন করে স্বৈরাচারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাঁরা আত্মস্বীকৃত জাতীয় বেইমানে পরিণত হয়েছিলেন। ৫৭ বছর বয়সে রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার অঙ্গীকারও অবলীলায় ভঙ্গ করতে দেশবাসী দেখেছে। এ রকম আরো বহু উদাহরণ রয়েছে।
তবুও তাদের প্রতিশ্রুতির কারণে ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর পর আন্দোলনের কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার কথা বিশ্বাস করে আমাদের সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যে সঠিক ছিল না তা আমরা অচিরেই বুঝতে পারি। কারণ, আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত করার পর সারা দেশে যৌথ বাহিনীর অভিযানের নামে তারা এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ ও নির্যাতনের মাধ্যমে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। বিরোধী দলমতের শত শত নেতা-কর্মীকে হত্যা ও গুম করা হয়। তাদের আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের সদস্যদের ওপরেও নির্যাতন চালানো হয়। রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত পল্লী পর্যন্ত চলতে থাকে এই হত্যা ও উৎপীড়নের তাণ্ডব। রাজনীতি করার স্বাভাবিক অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়। এত কিছু সত্ত্বেও আমরা দীর্ঘ এক বছর অপেক্ষা করেছি। বারবার আলোচনার আহ্বান জানিয়েছি। কারণ আমরা সমঝোতা ও শান্তিতে বিশ্বাসী।
অতীতেও আমরা সব সময়েই রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা, সংযম, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সমঝোতার জন্য সব সময় এগিয়ে গিয়েছি। কিন্তু তারা বরাবরই সংঘাত ও সংঘর্ষের পথ বেছে নিয়েছে।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর ১৯৯১ সালে জনগণের ভোটে আমরা নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব নিলে তারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, একদিনও শান্তিতে থাকতে দেব না। তারপর তারা কেমন সহিংস পন্থায় তাদের সেই ঘোষণা কার্যকর করেছে তা দেশবাসী দেখেছেন।
এবারও তারা অস্ত্রের ভাষায় আমাদের দমিয়ে রাখতে চেয়েছে। সচেতন ও বিবেকবান কোনো নাগরিক সমঝোতার কথা বললেই তারা তাঁকে অপমাণিত ও লাঞ্ছিত করেছে।
আমরা আলোচনার ভিত্তি হিসেবে সাত দফা প্রস্তাব তুলে ধরি। তারা সঙ্গে সঙ্গে তা নাকচ করে দেয়। এই পরিস্থিতিতে সংকট নিরসন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং ভোটাধিকারসহ জনগণের সকল অধিকার ফিরিয়ে আনতে আন্দোলন ছাড়া আর কোনো পথ আমাদের সামনে খোলা রাখা হয়নি। তাই আমরা বাধ্য হয়ে আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েছি।
আপনারা জানেন, গত ৫ জানুয়ারি প্রহসনের নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিনটিকে আমরা গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে পালনের কর্মসূচি দিয়েছিলাম। ঢাকায় আমাদের সমাবেশ ও মিছিলের কর্মসূচি ছিল। সেই কর্মসূচি বানচালের উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীনরা ৩ জানুয়ারি থেকে অঘোষিতভাবে দেশ অবরুদ্ধ করে ফেলে।
সড়ক ও নৌপথে সব যানবাহন চলাচল বন্ধ করে রাজধানীকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়।
আমাদের কর্মসূচির আগের রাতেই আমাকে এই কার্যালয়ে বালু ও ইটবোঝাই ট্রাক, জলকামান ও সাঁজোয়া যান দিয়ে ঘিরে অবরুদ্ধ করা হয়। পুলিশ বাইরে থেকে গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়। ৫ জানুয়ারি বিকেলে আমি সমাবেশে যোগদানের উদ্দেশে বেরুতে চাইলে বাধা দেওয়া হয়। আমিসহ ভেতরে অবস্থানরত সকলের ওপর বাইরে থেকে দফায় দফায় বিষাক্ত পিপার স্প্রে ছোড়া হয়। প্রাণহানির আশঙ্কা থাকায় মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এই পিপার স্প্রে ব্যবহার আমাদের দেশেও উচ্চ আদালত নিষিদ্ধ করেছেন। সেই পিপার স্প্রে প্রয়োগের কারণে আমি এবং সাংবাদিকসহ অনেকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এর আগে গাজীপুরেও আমার জনসভা ১৪৪ ধারা জারি করে বন্ধ করা হয়। আমি আদালতে হাজিরা দিতে গেলে আমার গাড়িবহরে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা সশস্ত্র হামলা করে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাদের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ অনেককে গ্রেফতার করা হয়।
এভাবে বিরোধী রাজনীতি ও ভিন্নমতকে এরা দমন করে দেশে কার্যত একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করে ফেলেছে। সংবাদমাধ্যমকে ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে প্রচারযন্ত্র ব্যবহার করছে। মানুষের সব অধিকার তারা কেড়ে নিয়েছে।
এর বিরুদ্ধে লড়াই না করলে আমাদের স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে। তাই আমরা আন্দোলনের ডাক দিয়েছি। জনগণের সেই গণতান্ত্রিক আন্দোলন এখন চলছে। শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ স্বাভাবিক করতে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং একের পর এক উসকানিমূলক আচরণ করে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটানো হচ্ছে। কাজেই যৌক্তিক পরিণতিতে না পৌঁছা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
আন্দোলনে দেশবাসী ও নেতা-কর্মীর কষ্ট ও ক্ষয়ক্ষতির কথা আমরা জানি ও বুঝি। এ সম্পর্কে সকলেই সচেতন। কেবল ক্ষমতাসীনদের কোনো বোধোদয় নেই। জনগণের দুর্দশা লাঘবের চেয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকাই তাদের কাছে বড়।
সাহসিকতার সঙ্গে সবাই অংশগ্রহণ করলে এ আন্দোলন অচিরেই সফল হবে ইনশাআল্লাহ্। এই সাময়িক কষ্ট জাতির বৃহত্তর স্বার্থে স্বীকার করার জন্য আমি সকলের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।
সংবাদমাধ্যমের প্রিয় সদস্যবৃন্দ,
অবৈধ স্বৈরাচারী শাসকরা হত্যা ও উৎপীড়ন চালিয়ে বহু মায়ের কোল খালি করে চলেছে। প্রতিটি জনপদে আজ স্বজনহারা মানুষের কান্নার রোল। এই কান্না অত্যাচারীদের কানে পৌঁছায় না। কে কখন গুম, খুন ও ক্রসফায়ারের শিকার হবে তা নিয়ে সবাই আতঙ্কিত। শত শত তরুণকে আটক করে গুলি ও নির্যাতনে পঙ্গু করে দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যেও সারা দেশে যাঁরা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন, আমি তাঁদের সাধুবাদ দেই।
গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে সকল শ্রেণীর জনগণ, দল-জোটের নেতা-কর্মী, শুভানুধ্যায়ী, সমর্থক ও সাংবাদিক বন্ধুরাসহ সবাই যে নির্যাতন, জেল-জুলুম ও দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন, তার জন্য প্রত্যেককে ধন্যবাদ জানাই। যাঁরা নিহত, আহত ও গুম হয়েছেন বেদনাহত চিত্তে তাঁদের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সমাবেদনা জানাই। আল্লাহর রহমতে দিন পরিবর্তন হলে আমরা অবশ্যই আপনাদের পাশে দাঁড়াব।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের যেসব বন্ধুরাষ্ট্র এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং গণমাধ্যম ও সিভিল সমাজের সদস্যবৃন্দ উদ্বেগ প্রকাশ করে সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কথা বলেছেন, আমি তাঁদের ধন্যবাদ জানাই।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র ও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক মানুষ জীবন দিয়েছে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। উন্নত কিংবা অনুন্নত কোনো দেশেই গণতন্ত্র ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই এবং সংগ্রামী মানুষের আত্মত্যাগ কখনো বৃথা যায়নি। বাংলাদেশেও তা বৃথা যাবে না ইনশাআল্লাহ্।
বিএনপি হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি, গণতন্ত্রিক রাজনীতিতে হত্যা ও সন্ত্রাসের কোনো স্থান নেই। তারপরও আমরা লক্ষ্য করেছি যে, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের বর্তমান আন্দোলন চলাকালে সরকার বিভিন্ন হিংসাত্মক পন্থার আশ্রয় নিয়েছে। সরকারের এই দমন-পীড়ন জাতীয় ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করি যে, বিরাজমান সমস্যা সমাধানে :
ক. জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সারা দেশে যেসব নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।
গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। পুলিশি ও যৌথ বাহিনীর হয়রানি বন্ধ করতে হবে এবং নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত হয়রানিমূলক সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। বিচারবহির্ভূত প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে হবে।
খ. সভা-সমাবেশ-মিছিলসহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর আরোপিত সকল প্রকার বিধিনিষেধ অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
গ. সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে সকলের অংশগ্রহণে অনতিবিলম্বে জাতীয় সংসদের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে সংলাপের আয়োজন করতে হবে।
আমাদের বিশ্বাস, এই প্রক্রিয়াতেই আমরা সমস্যা সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে পারব। আন্দোলনকে দ্রুত নিয়ে আসতে পারব শান্তিপূর্ণ সমঝোতার পথে।
জীবনের এই প্রান্তে ক্ষমতা আমরা কাছে বড় কিছু নয়। দেশবাসীর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আমি অতীতে কয়েকবার দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছি। প্রিয় সেই দেশবাসীর জন্য তাদের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতেই আমরা লড়াই করছি। এই আন্দোলন কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তির নয়। কোনো দলের বিরুদ্ধে কোনো দলের নয়। এ আন্দোলন আদর্শের। এ আন্দোলন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার। এ আন্দোলন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সকলের।
আজকের এই আন্দোলন ক্ষমতা দখলের আন্দোলন নয়। এই আন্দোলন একটি গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ ও আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ে তোলার আন্দোলন।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যে সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলা হয়েছে তার বাস্তবায়নের মাধ্যমেই একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। দেশের মালিকানা আমরা তাই দেশের মানুষের কাছে ফিরিয়ে দিতে চাই। যাতে ভোটের অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারাই সিদ্ধান্ত দিতে পারে তাদের পক্ষে কারা দেশ পরিচালনা করবে।
আমি এ আন্দোলনে দল-মত-পেশা-শ্রেণী নির্বিশেষে সকল ব্যক্তি ও শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে শামিল হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। আমার আহ্বান, যাঁরা এখনো নিষ্ক্রীয় আছেন তাঁরা সক্রিয় হোন। নিজ নিজ অবস্থান ও এলাকায় আন্দোলন গড়ে তুলুন। আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বৃহত্তর গড়ে তুলুন জাতীয় ঐক্য।
প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ,
আমরা যখনই জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করেছি, তখনই বিভ্রান্তি ছড়াবার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ অপপ্রচারণার নোংরা পথ বেছে নিয়েছে। কখনো তারা বলেছে মুজিব হত্যার বিচার ঠেকাতে এবং কখনো বলেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রোধে নাকি আমরা আন্দোলনে নেমেছি।
তাদের এসব অপপ্রচার জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি।
এবারও গণবিচ্ছিন্ন শাসকগোষ্ঠী জনগণের আন্দোলনে ভীত হয়ে হত্যা-উৎপীড়নের পাশাপাশি ষড়যন্ত্র, নাশকতা ও অপপ্রচারণায় মেতে উঠেছে। তারা এখন পুরোপুরি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর নির্ভর করে টিকে থাকতে চাইছে। সেই উদ্দেশ্যে এসব বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের ভার কতিপয় দলবাজ কর্মকর্তার হাতে তুলে দিয়ে তাদের মাধ্যমে পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও আনসার বাহিনীকে বিরোধী দল ও জনগণকে নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত করছে। আমরা বারবার বলেছি, আজ আবারও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহকে আইনসম্মতভাবে কর্তব্য পালনের আহ্বান জানাচ্ছি।
হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, অপহরণ, নির্যাতন, বন্দী অবস্থায় গুলি করে পঙ্গু করা, বাড়িঘরে হামলা, পাইকারি গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলা দায়েরের বেআইনি প্রক্রিয়া থেকে তাদের দূরে থাকতে বলছি।
দেশবাসী জানেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি বরাবরই সন্ত্রাস ও সহিংসতা-নির্ভর। অতীতে আন্দোলনের নামে তারা যে ভয়াবহ সন্ত্রাস চালিয়েছে, তা সকলেরই জানা। মাসের পর মাস টানা হরতাল-অবরোধ-অসহযোগ কর্মসূচির নামে তারা নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের সময়ে যাত্রীবাসে গানপাউডার দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে যাত্রাবাড়ীতে ১৮ জন এবং শেরাটন হোটেলের কাছে ১১ জন যাত্রীকে তারা জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিল। ওই দুটি পৈশাচিক ঘটনায় দগ্ধ আরো ১২ জন পরে হাসপাতালে প্রাণ হারান। এ ছাড়া বোমা ও ককটেল মেরে এবং পিটিয়ে তারা বহু নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপরও আক্রমণ করেছে। তাদের সন্ত্রাসের কারণে এসএসসি পরীক্ষা তিন মাস পর্যন্ত পিছাতে হয়েছে। পবিত্র রমজান মাসেও তারা হরতাল করেছে। যমুনা সেতুর নির্মাণকাজ উদ্বোধনের দিনে হরতাল দিয়েছে।
স্বল্পমেয়াদি সপ্তম সংসদের নিয়ম রক্ষার নির্বাচন বর্জন করে সেই নির্বাচন ঠেকাতে তারা ‘গণকারফ্যু’ জারি করে দেশব্যাপী হত্যা ও ধ্বংসের তাণ্ডব চালিয়েছিল।
এই আওয়ামী লীগ আন্দোলনের নামে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর অচল এবং রেলস্টেশন, যানবাহন, অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেছে। অফিসগামী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রকাশ্য রাজপথে বিবস্ত্র করেছে। লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে লাশের ওপর নৃত্য করেছে। এসব পৈশাচিক তাণ্ডবের প্রকাশ্য নির্দেশ শেখ হাসিনা নিজে দিয়েছেন এবং এসবের বহু দালিলিক প্রমাণও রয়ে গেছে।
আওয়ামী লীগ আজ বিচার বিভাগের মর্যাদার কথা বলে। অথচ তারা রায় পছন্দ না হওয়ায় বিচারকদের বিরুদ্ধে লাঠি মিছিল করেছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বস্তি বসিয়েছে। দেশের প্রধান বিচারপতির এজলাসে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে। ক্ষমতায় বসেই তারা নিজেদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো প্রত্যাহার করেছে। সাজাপ্রাপ্ত খুনের আসামিদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমায় মুক্ত করেছে।
সন্ত্রাসের দানব সেই আওয়ামী লীগ এবার আন্দোলন শুরুর পর থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ছত্রছায়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে বিরোধী দলের কর্মীদের হত্যা, গুম ও বন্দী অবস্থায় গুলি করে পঙ্গু করা শুরু করে।
আমাদের দল-জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে গুলি চালানো হয়। গুলিতে রিয়াজ রহমানের মতো সজ্জন ব্যক্তি গুরুতর আহত হন। প্রবীণ রাজনীতিক তরিকুল ইসলামসহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতাদের বাড়ি-ঘর, অফিস ও যানবাহনে গুলি, বোমা হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। আমাদের দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দসহ সারা দেশে প্রায় ১০ হাজার নেতা-কর্মীকে গত দুই মাসে তারা কারারুদ্ধ করেছে। লাখ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে।
বিরোধী দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে তাদেরকে নজিরবিহীনভাবে দীর্ঘদিন ধরে রিমান্ডে রেখে নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
আমাদের দলের অন্যতম যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদকে একের পর এক মিথ্যা মামলায় প্রায় এক মাস ধরে দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে নানাভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে। জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত বিরোধী দল সমর্থক মেয়রদের মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে দলীয় লোক বসানের জন্য তাঁদের বরখাস্ত করা হচ্ছে। বিনা ভোটে ক্ষমতায় আসা শাসকদের কাছে জনগণের ভোটের যে কোনো মূল্য নেই. তা তারা হাতেনাতে প্রমাণ করছে। অথচ আমাদের আমলে আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে ঢাকার মেয়র তথাকথিত ‘জনতার মঞ্চ’ গঠন করে রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন।
একই দলের নেতা হিসেবে চট্টগ্রামের মেয়র সমুদ্র বন্দর অচল করায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আমরা তাদের বরখাস্ত করিনি।
আমাদের দলের অন্যতম যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ সম্পর্কে আপনারা জানেন। তাঁকে গ্রেফতার করেও গত তিন দিনেও সরকার স্বীকার করেনি। এখন পর্যন্ত তার কোনো হদিস নেই। নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নার ব্যাপারেও সরকার প্রথম অস্বীকার করে পরে নাটক সাজিয়ে ২১ ঘণ্টা পর তাঁকে গ্রেফতার দেখায়।
আপনারা জানেন, সম্প্রতি ক্ষমতাসীনরা বিরোধী দলের বক্তব্য-বিবৃতি সংবাদ-মাধ্যমে প্রচার না করার নির্দেশ দেয়।
তারপরেও বিএনপি ও ২০ দলের পক্ষে সালাহ উদ্দিন আহমেদের দেওয়া বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারিত হতে থাকায় তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি আবারও অবিলম্বে সালাহ উদ্দিন আহমেদকে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। অন্যথায় এর পরিণতি শুভ হবে না।
আমাকে কত হীন পন্থায় হয়রানি ও হেনস্তা করা হয়েছে ও হচ্ছে; আমি তার বিবরণ দিতে চাই না। দেশবাসী সব জানেন এবং দেখছেন।
প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ,
এত কিছু করেও উদ্দেশ্য হাসিল না হওয়াতে আওয়ামী লীগ অন্তর্ঘাত ও নাশকতার পথ বেছে নিয়েছে। পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর প্রহরায় কিছু যানবাহন রাস্তায় নামায়।
সেসব যানবাহনে পেট্রলবোমা মেরে নারী-শিশুসহ নিরপরাধ মানুষকে দগ্ধ করে শোচনীয় মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আমরা এসব পৈশাচিক বর্বরতার তীব্র নিন্দা জানিয়ে আসছি। হীন সন্ত্রাসে জড়িতদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তিরও দাবি করে চলেছি। কিন্তু আমাদের আহ্বানে তারা কর্ণপাত করেনি। তারা তাদের ষড়যন্ত্রের নীলনকশ বাস্তবায়নে এগিয়ে গেছে এবং নিরপরাধ মানুষের শোচনীয় মৃত্যুকে তারা তাদের ঘৃণ্য রাজনীতির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে।
দেশে যখন নিরপরাধ মানুষকে নির্বিচারে হত্যার মতো পৈশাচিক ঘটনা ঘটছে, তখন বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ও তথ্য প্রমাণের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করে গ্রেফতারের কোনো উদ্যোগ নেই। তার বদলে চলছে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে একতরফা অপপ্রচার। কোনো ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিনা তদন্তে ও তথ্য-প্রমাণ ছাড়া মামলা দায়ের করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের দায়ী করে ক্রমাগত বক্তব্য রাখা হচ্ছে। যার ফলে তদন্ত প্রভাবিত এবং ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ হচ্ছে।
অথচ সরকারি দলের চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বোমাসহ গ্রেফতার এবং এর কোনো কোনো খবর সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পরেও উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। আওয়ামী নেতারা সার্টিফিকেট দিয়েও তাদের ছাড়িয়ে নিচ্ছে। এতে প্রকৃত অপরাধীরা আড়ালে চলে যাচ্ছে এবং পার পাচ্ছে।
দেশবাসী প্রতিনিয়ত দেখছেন, ছাত্রলীগ-যুবলীগ সন্ত্রাসীরা দখল ও টেন্ডারবাজীতে জড়িয়ে গোলাগুলি করছে, সশস্ত্র সংঘাতে জড়াচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সাংবাদিকদের ওপরেও সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে। বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ, মিছিলে হামলা করছে। তাদের নিজেদের মধ্যেও সশস্ত্র সংঘাত হচ্ছে। কিন্তু কাউকেই ধরা হচ্ছে না।
আমাদের অফিসগুলো তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ আমাদের বিরুদ্ধে একতরফা অপপ্রচারের উদ্দেশ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় শাসক দলের মুষ্টিমেয় সংখ্যক লোক দিয়ে বিভিন্ন স্থানে মহড়া করানো হচ্ছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ‘দেখামাত্র গুলি’ করার বেআইনি আদেশ দেওয়া হয়েছে। সন্ত্রাসের জন্য কলংকিত ছাত্রলীগের সদস্যদের অপরাধী ধরিয়ে দেয়ার নামে রাষ্ট্রীয় অর্থে পুরস্কত করা হচ্ছে। এসবের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতিকে আরো নৈরাজ্যকর করে তোলা হচ্ছে।
আমি পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই যে, জনগণের জানমালের নিরপত্তা দিতে ব্যর্থ এই শাসক মহলই সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিয়ে যানবাহনে তুলে পরিকল্পিতভাবে শোচনীয় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এসব পরিকল্পিত বোমা হামলার সঙ্গে তারাই জড়িত বলে দেশের বেশির ভাগ মানুষ মনে করে। নিরপরাধ মানুষের জীবনকে যারা রাজনীতির পণ্যে পরিণত করে তাদের ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার নেই।
রাজনৈতিক সংকট সমাধানের কোনো সদিচ্ছা এই সরকারের নেই। তারা সংকটকে দীর্ঘায়িত করতে চায়। সেই উদ্দেশ্যেই আন্দোলন চলাকালে তারা অন্তর্ঘাত ও নাশকতা চালিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে জঙ্গি তৎপরতা বলে দেশে-বিদেশে অপপ্রচার চালাচ্ছে। সকলেই জানেন যে, তাদের শাসনামলেই এ দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ও বিস্তার ঘটেছিল। আমরা সরকারে আসার পর জঙ্গিবাদী নেতাদের গ্রেফতার ও বিচার করে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করেছিলাম। তাদের নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণ ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। আজ বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সহায়তায় জঙ্গিদের আটকাবস্থা থেকে পালানোর সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।
জনগণের ন্যায্য দাবি অগ্রাহ্য করার উদ্দেশ্যেই তারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে জঙ্গি তৎপরতা হিসেবে অপপ্রচার করছে। এর ফল কখনো ভালো হতে পারে না। এতে প্রকৃত জঙ্গিবাদীরাই সুবিধা পাবে; যা কারোরই কাম্য নয়।
আমি আবারও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই যে, বিএনপি ও ২০ দল নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করার ভয়ংকর রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। আমাদের আন্দোলন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। তাদের জীবননাশের আন্দোলন নয়। কাজেই পক্ষপাতহীন ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের মাধ্যমে এইসব জীবনসংহারী সন্ত্রাসের প্রকৃত হোতাদের শনাক্ত করে কঠিন শাস্তির দাবি আমি পুনর্ব্যক্ত করছি।
এসব ঘটনায় জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি বিধানকল্পে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানাচ্ছি।
সাংবাদিক ভাই-বোনেরা,
আমরা জনগণের ভোটের অধিকারসহ সকল গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য আন্দোলন করছি। কাজেই জনগণ আমাদের সঙ্গে আছেন। আমরা তাদেরকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারি না। সাধারণ মানুষকে বোমা মেরে ও পুড়িয়ে হত্যা এবং এ নিয়ে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে প্রচারণা এবং নির্যাতন চালিয়ে ক্ষমতাসীনরাই সুবিধা পাবে। কাজেই ক্ষমতাসীনরা সুবিধা পায় এমন কোনো অপকর্মে আমাদের কেউ জড়িত থাকার প্রশ্ন ওঠে না।
ইতিহাসসচেতন সকলেই জানেন যে, জার্মানির নাৎসি নেতা হিটলার ১৯৩৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাইখস্ট্যাগে আগুন লাগিয়ে সেই দায় বিরোধীদের ওপর চাপিয়ে অনুগত মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছিলেন। এরপর নির্মম ও নিষ্ঠুর পন্থায় বিরোধী দল ও মতকে তিনি দমন করেছিলেন। বাংলাদেশে হিটলারের খুদে প্রেতাত্মারা আজ সেই পথ অনুসরণের ব্যর্থ অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এসব অপতৎপরতায় হিটলারের যেমন শেষ রক্ষা হয়নি, তার অনুসারী বাংলাদেশি খুদে হিটলাররাও চূড়ান্ত বিবেচনায় পরাজিত হবে ইনশাআল্লাহ।
ক্ষমতাসীনরা প্রতিনিয়ত আমাকে জেল-জুলুম ও ফাঁসির ভয় দেখাচ্ছে। নানাভাবে হেনস্তা করছে। আমাদেরকে টার্গেট করে অশ্রাব্য ভাষায় অপপ্রচার চালাচ্ছে। এসবে কোনো লাভ হবে না। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সকলের অংশগ্রহণে দ্রুত একটি নির্বাচনের আয়োজন করলেই কেবল চলমান সংকটের সুরাহা হবে।
এ নিয়ে ক্ষমতাসীনরা যদি কোনো আলোচনা করতে না চায়, তাহলে সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব এককভাবে তাদের ওপরেই বর্তাবে। তথাকথিত হলেও একটি সংসদের অধিবেশন চলছে। একতরফাভাবে যে বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী তারা পাস করেছে তা তারা একতরফাভাবে বাতিলও করে দিতে পারে। তাতে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পথ খুলবে। এই সংশোধনীর পর বর্তমান ক্ষমতাসীনরা পদত্যাগ করে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করলেই দেশে সংকটের অবসান ঘটবে।
সংকট নিরসনের জন্য ১৯৯৬ সালে আমরা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন করে সংবিধান সংশোধনের পর পদত্যাগ করে আমাদের অঙ্গীকার পূরণ করেছিলাম। এখন শেখ হাসিনা অন্তত এবার যদি তাঁর অঙ্গীকার পূরণ করেন তাহলেই দেশে শান্তি, স্বস্তি ও সমঝোতার পরিবেশ ফিরে আসবে। মানুষ মুক্তি পাবে।
সামনে মহান স্বাধীনতার দিবস। জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। সেই স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে, জনগণের স্বাধীনতা এবং মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের তেমন জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। আজকের সংকট সমাধানের চাবিকাঠি ক্ষমতাসীনদের হাতে। সংকট নিরসনের মাধ্যমে তারা সেই কাঙ্ক্ষিত জাতীয় ঐক্যের পথ খুলে দিতে পারে।
তাহলেই আমরা সংকটমুক্ত হয়ে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতির ৪৫তম স্বাধীনতা দিবস পালন করতে পারব।
আমি আশা করি, ক্ষমতাসীনদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। তারা সমঝোতার পথে ফিরে আসবে। আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যমান সংকট দ্রুত নিরসনের উদ্যাগ নেবে। আজ এখানেই শেষ করছি। আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ।
আল্লাহ হাফেজ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।

অনলাইন ডেস্ক