বাংলাবান্ধা দিয়ে কাল থেকে মানুষ পারাপার শুরু
পঞ্চগড়ের সর্বত্রই এখন আনন্দের জোয়ার। পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে মানুষ পারাপারের (ইমিগ্রেশন) দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হওয়ার সংবাদে পঞ্চগড়ে এখন চলছে আনন্দ মিছিল, মিষ্টি খাওয়া ও খাওয়ানো।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জেনারেল (অব.) ড. বিজয় কুমার সিং যৌথভাবে মানুষ পারাপার কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন। অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলাও উপস্থিত থাকবেন। এরইমধ্যে মানুষ পারাপার কার্যক্রম উদ্বোধনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা।
মানুষ পারাপার (ইমিগ্রেশন) কার্যক্রম উদ্বোধন উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার রাতে পঞ্চগড় চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি চেম্বার ভবনে প্রেস বিফ্রিংয়ের আয়োজন করা হয়। চেম্বারের প্রেসিডেন্ট আশরাফুল আলম পাটোয়ারীর সভাপতিত্বে সভায় ভাইস প্রেসিডেন্ট কামরুজ্জামান শাহান শাহ, কোষাধ্যক্ষ পরিচালক রেজাউল করিম রেজা, ইউনুস শেখসহ জেলার বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ব্রিফিং শেষে একে অপরকে মিষ্টি খাওয়ান এবং উপস্থিত সবার মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করা হয়।
এ উপলক্ষে আজ বুধবার দুপুরে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসনও সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিনের সভাপতিত্বে এ সময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. মাহামুদুল আলম, পঞ্চগড় প্রেসক্লাবের সভাপতি এ রহমান মুকুল, সাধারণ সম্পাদক সফিকুল আলম সফিক, সাংবাদিক শহীদুল ইসলাম শহীদসহ জেলায় কর্মরত সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়া জেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে গতকাল রাতে জেলা শহরে আনন্দ মিছিল বের হয়। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পঞ্চগড় সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদাত সম্রাট আনন্দ মিছিলের নেতৃত্ব দেন। মিছিল শেষে দলীয় কার্যালয়ে মিষ্টি বিতরণ করা হয়।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৬ সালের সাফটা চুক্তি অনুযায়ী বিশ্বজনীন অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধায় বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যক্রম শুরু হয়। তৎকালীন ও বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ আনুষ্ঠানিকভাবে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।
পরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার, বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সহজীকরণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ২০১১ সালের ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। বাংলাবান্ধায় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এবং ভারতের ফুলবাড়ীতে ভারতের তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে এ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।
ওই সময়েই তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে ইমিগ্রেশন চালু করার কথা ঘোষণা করা হয়। পরে চার দেশের সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কূটনীতিকরা একাধিকবার বাংলাবান্ধা সফর ও পরিদর্শন করেন। এরপর একাধিকবার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে ইমিগ্রেশন চালু হওয়ার বিষয়টি শোনা গেলেও দীর্ঘদিনেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে পঞ্চগড় জেলাবাসী আশাহত হয়। এ স্থলবন্দর দিয়ে ইমিগ্রেশন চালুর দাবি করে আসছিল তারা। অবশেষে পাঁচ বছর ২৬ দিন পর চালু হচ্ছে বাংলাবান্ধা-ফুলবাড়ী দিয়ে মানুষ পারাপার কার্যক্রম।
ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (সিএন্ডএফ) পঞ্চগড় জেলা শাখার সভাপতি রেজাউল করিম রেজা ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট চালু হওয়ায় অত্যন্ত খুশি। তিনি বলেন, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে মানুষ পারাপার শুরু হলে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। পঞ্চগড়সহ দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হবে, বাড়বে কর্মসংস্থান। ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে। সর্বোপরি মানুষের দুর্ভোগ কমবে। সময় ও অর্থ দুটোরই সাশ্রয় হবে। শিক্ষা, চিকিৎসা ও ভ্রমণে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর অতুলনীয়।
আমদানি রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশন পঞ্চগড় জেলা শাখার সভাপতি মেহেদী হাসান খান বাবলা বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট চালু করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরই একমাত্র বন্দর যার মাধ্যমে সড়ক পথে চতুর্দেশীয় (ভারত, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশ) যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে। এ স্থলবন্দর দিয়ে চীনও যুক্ত হতে পারে। মানুষ পারাপার চালু হলে চার দেশই লাভবান হবে। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট চালু হওয়ায় চার দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ও হাব গড়ে উঠবে।
পঞ্চগড় পৌরসভার মেয়র মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট চালু হওয়ায় পঞ্চগড় এখন পর্যটন ও শিল্প নগরীতে রূপ নিবে। বিদেশি পর্যটকরা এখন স্বল্প খরচে সহজেই এ স্থলবন্দর ব্যবহার করে সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার পতেঙ্গা, কুয়াকাটা, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, সিলেটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরতে পারবে। আবার বাংলাদেশি পর্যটকরাও কম খরচে সহজেই ভারত, নেপাল ও ভুটানের আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা দেখতে পাবে।
বাংলাবান্ধা-ফুলবাড়ী স্থলবন্দর থেকে ভারতের শিলিগুড়ি শহর মাত্র ৮ কিলোমিটার, জলপাইগুড়ি শহর ১০ কিলোমিটার, দার্জিলিং ৫৮ কিলোমিটার, নেপালের কারকরভিটা ৬১ কিলোমিটার, ভুটানের ফুয়েন্টসিলিং শহর মাত্র ৬৮ কিলোমিটার। শিলিগুড়ি ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় সেভেন সিস্টারের একমাত্র প্রবেশ পথ। পর্যটকরা যাতায়াত করলে লাভবান হবে সব দেশ।
আনোয়ার সাদাত সম্রাটও বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরকে ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট চালুসহ পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরে রূপ দেওয়ায় পঞ্চগড়ের সর্বস্তরের মানুষের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, পঞ্চগড়সহ এই এলাকার মানুষ ভারতে যেতে (লালমনিরহাটের পাটগ্রামের চেংরাবান্ধা, দিনাজপুরের হিলি, যশোরের বেনাপোল) দুর্ভোগ পোহাতে হতো। এখন বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে তাঁরা অল্প খরচে সহজেই যেতে পারবে।
পঞ্চগড় চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আশরাফুল আলম পাটোয়ারী জানান, ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন, অবস্থানগতসহ নানা কারণে কারণে ও চমৎকার অবকাঠামো এবং উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবাদে বাংলাবান্ধা অন্যতম স্থলবন্দর। ইমিগ্রেশনসহ পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হিসেবেই বাংলাবান্ধা চালু হতে যাচ্ছে। এর ফলে পঞ্চগড়ের তো বটেই গোটা দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। আর এই স্থলবন্দরটি হবে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক স্থলবন্দর।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন ও পুলিশ সুপার মো. গিয়াস উদ্দিন আহমদ জানান, গত রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে ইমিগ্রেশন সুবিধা চালুর বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। উদ্বোধনের সব প্রস্ততি সম্পন্ন হয়েছে।