কুলিয়ারচরে যুবককে হত্যা, কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে মামলা
কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের দাসপাড়া এলাকায় মৃণাল কান্তি দাস সানী (৩০) নামের এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। এতে কুলিয়ারচর পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সুব্রত দাসকে প্রধান করে ৩৫ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরো চার-পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে।
নিহত সানীর বাবা রঞ্জিত দাস আজ শুক্রবার বিকেলে কুলিয়ারচর থানায় এ মামলা করেন। এর আগে পুলিশ গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে প্রদীপ কুমার দাস সুবল নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। সুবল একই এলাকার দ্বীনবন্ধু দাসের ছেলে এবং প্রধান আসামি কাউন্সিলর সুব্রত দাসের চাচাতো ভাই।
আজ শুক্রবার দুপুরে সানীর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায় পুলিশ।
এদিকে সানীর বাড়িতে চলছে স্বজনদের মাতম। তাঁর মা, স্থানীয় উসমানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নিহির বালা দাস পুত্রশোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের কোনো সান্ত্বনার বাণীই তাঁর বুক চাপড়ানো আর্তনাদ থামাতে পারছে না।
সানীর একমাত্র বড় ভাই, কুলিয়ারচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. রাজেস কান্তি দাস পাগলপ্রায়। দুই ভাইয়ের প্রতিদিনের মধুর খুনসুটির স্মৃতি হাতড়ে বিলাপ করছিলেন তিনি। তিনি জানান, কাউন্সিলর সুব্রত দাসের লোকজনের জন্য সব সময় আতঙ্কে দিন কাটে তাঁদের পরিবারের। সেই আতঙ্কই মর্মান্তিক বাস্তবতা হয়ে নেমে এলো তাদের ওপর।
প্রতিবেশীরা জানায়, গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে কুলিয়ারচর পৌরসভার দাসপাড়ায় কালীমন্দিরের সামনে হামলাকারীদের হাত থেকে বাঁচতে সানী পাশের এক বাড়ির দিকে দৌড়ে যান। পরে খুনিরা ওই বাড়ির উঠানে ফেলেই তাঁকে উপর্যুপরি কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে। ঘরের দরজার আড়াল থেকে সেই দৃশ্য দেখা গৃহবধূ ইতি রানীর আতঙ্ক এখনো কাটেনি।
ইতি রানী জানান, বাঁচার জন্য অনেক চেষ্টা করেও সানী খুনিদের ধারালো অস্ত্রের আক্রমণের সামনে দাঁড়াতে পারেননি। খুনিরা চলে যাওয়ার পর ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায়ও আক্রমণকারী কয়েকজনের নাম বলে চিৎকার করছিলেন সানী।
কেন এই নির্মম হত্যাকাণ্ড? এই প্রশ্নের উত্তরে প্রতিবেশী-আত্মীয় সবার একই জবাব। আর সেটি হলো বাড়ির সামনের কালীমন্দিরের সাড়ে পাঁচ শতাংশ ভূমি, যা অবৈধভাবে জোর করে দখল করে রেখেছেন পৌর কাউন্সিলর সুব্রত দাস। এই ভূমি নিয়েই বিরোধ। একদিকে সুব্রত দাস আর অপরদিকে পুরো দাসপাড়ার যুবসমাজ। প্রতিবাদী সেই যুবকের মধ্যে সানীও একজন। আছেন তাঁর ফুফাতো ভাই পলাশ চৌধুরী।
পলাশ চৌধুরী মাস ছয়েক আগে মন্দিরের ভূমি দখলের প্রতিবাদে এক সংবাদ সম্মেলন করেন। এর জেরে কয়েকদিন পর সুব্রত দাসের লোকজন পলাশের ওপর হামলা চালায়। এতে তিনি আহত হন। ঘটনার দিন থানায় মামলা করে ফেরার সময় পথে সুব্রতকে পেয়ে লাঞ্ছিত করেন সানী। গুরুজনের গায়ে হাত ওঠানোর দায়ে পরে এক সালিস দরবারে সানীকে মারধরসহ ক্ষমা প্রার্থনা করানো হয় সুব্রত দাসের কাছে।
তখন পৌরসভার নির্বাচন কাছে থাকায় সালিসে সন্তুষ্ট থাকলেও অন্তরে ঠিকই বিষ পুষে রাখেন সুব্রত দাস-অভিযোগ সানীর পরিবারসহ গ্রামবাসীর। আর সুযোগ বুঝে সেই বিষ ঢেলে দেন সুব্রত।
ঘটনার পর থেকে গা-ঢাকা দেওয়ায় অভিযুক্ত পৌর কাউন্সিলর সুব্রত দাসের বক্তব্য নেওয়া যায়নি। তবে তাঁর স্ত্রী ঝর্ণা রানী দাসের দাবি, এই ঘটনার সঙ্গে তাঁর স্বামী বা সন্তানরা জড়িত নন।
এক প্রশ্নের উত্তরে ঝর্ণা জানান, এই রকম ইচ্ছা থাকলে সানী যখন তাঁর স্বামীকে লাঞ্ছিত করেছিল—তখনই করা যেত।
সানী দাস হত্যাকাণ্ডকে পূর্বপরিকল্পিত উল্লেখ করে কুলিয়ারচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) চৌধুরী মিজানুজ্জামান জানিয়েছেন, ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে। এরই মধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যান্য অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে পুলিশি তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
পুলিশ ও এলাকাবাসী জানায়, বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে সানী স্থানীয় কুলিয়ারচর বাজার থেকে ফেরার পথে দাসপাড়ায় নিজ বাড়িসংলগ্ন এলাকায় দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হন। দুর্বৃত্তরা অতর্কিতে তার ওপর হামলা চালিয়ে ধারাল দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করে। এ সময় তাঁর চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে এলে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়।
পরে স্বজনেরা সানীকে উদ্ধার করে বাজিতপুরের ভাগলপুর জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।