রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও মানহানি আইনের অপব্যবহার হচ্ছে
রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও মানহানির অভিযোগে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের মাধ্যমে আইনের অপব্যবহার করা হচ্ছে বলে মনে করেন দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, আইনের সংজ্ঞায় পড়ে না, তবু শুধু উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এসব মামলা করা হচ্ছে।
ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক মামলা হয়েছে। মাহফুজ আনামের কোনো কাজে বা কথায় ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ হয় এমন উপাদান না থাকা সত্ত্বেও অতি উৎসাহী কিছু ব্যক্তি কথায় কথায় এসব মামলা করছেন বলেও মত দেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করতে হয়। সাধারণ উৎসাহীরা কীভাবে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেন? তা ছাড়া সরকারের বিরোধিতা তো রাষ্ট্রবিরোধিতা নয়। রাষ্ট্র এবং সরকার এক জিনিস নয়।’
বিশিষ্ট এই আইনজীবী জানান, বাংলাদেশের প্রচলিত আইন এবং সংবিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে একই অপরাধে একাধিক মামলা হতে পারে না। মামলা হবে একটাই। তিনি বলেন, ‘মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করা হলে তাঁকে আদালতে গিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে। ৬০-৭০টি মামলা হয়রানি ছাড়া আর কিছুই না। তা ছাঁড়া যারা মামলা নিচ্ছেন, তাঁরা কীভাবে একই ঘটনায় একাধিক মামলা নিচ্ছেন, তা আমি বুঝতে পারছি না।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যদি মানহানি হয়ে থাকে, তাহলে তাঁকেই মানহানির মামলা করতে হবে বলে মন্তব্য করেন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘এটাই আইন। আর ক্ষতিপূরণের মামলা করতে হলেও সেটা তিনিই করবেন। কিন্তু আমার জানা মতে, তিনি কোনো মামলা করেননি।’ যাঁরা মামলা করছেন, তাঁদের ভিত্তি সম্পর্কেও প্রশ্ন রাখেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘একই ঘটনায় বা অপরাধে একাধিক মামলা হয়ে থাকলেও আলাদা-আলাদা বিচারের সুযোগ নেই। সবগুলোকে একটি মামলা হিসেবে বিবেচনা করাই আইনের নিয়ম।’
‘মানহানির মামলার ক্ষেত্রে যাঁর মানহানি হয়েছে, তিনি ছাড়া অন্য কেউ যদি প্রমাণ করতে পারেন যে এই মানহানি তাঁরও হয়েছে, একমাত্র তবেই তিনি মামলা করতে পারেন। যেমন ভাইয়ের মানহানি হলে তাঁর আরেক ভাই মামলা করতে পারেন। আর রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো আদালত বা থানার নেওয়ার সুযোগ নেই। কেউ আবেদন করলে করতে পারেন, কিন্তু তা কার্যকর হয় না,’ বলেন শ ম রেজাউল করিম।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কোনো কাজ মাহফুজ আনাম করেননি। আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা চলতে পারে না। এসব মামলা সরকারি দলের লোকেরা উৎসাহী হয়ে করছেন।’
আইন বিশ্লেষণ করে মাহবুব হোসেন বলেন, “বাংলাদেশ দণ্ডবিধি অনুযায়ী রাষ্ট্রদ্রোহিতার সংজ্ঞায় কোথাও এসব মামলার ভিত্তি নেই। বাংলাদেশে প্রচলিত দণ্ডবিধির ১২৪(ক) ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি উচ্চারিত বা লিখিত কথা বা উক্তি দ্বারা, কিংবা চিহ্নাদি দ্বারা, কিংবা দৃশ্যমান প্রতীকের সাহায্যে কিংবা অন্য কোনোভাবে বাংলাদেশ বা আইনানুসারে প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা করার চেষ্টা করে কিংবা বৈরিতা উদ্রেক করে বা করার চেষ্টা করে তাহলে সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কিংবা যে কোনো কম মেয়াদের কারাদণ্ডে যার সঙ্গে জরিমানা যুক্ত করা যাবে, কিংবা ৩ বৎসর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তৎসহ তাকে জরিমানায়ও দণ্ডিত করা যাবে’।”
এই আইনজীবী আরো বলেন, “দণ্ডবিধির ১২১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বা যুদ্ধ ঘোষণার উদ্যোগ বা যুদ্ধ ঘোষণায় সহায়তা করলে সেই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে।’
১২১(ক) ধারায় বলা হয়েছে, ‘১২১ ধারায় দণ্ডিত অপরাধ সংগঠনের ষড়যন্ত্র করলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। ১২২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করলে সেই ব্যক্তিও যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে।’
“১২৩ ধারা অনুযায়ী, ‘এ ধরনের অপরাধ সুগম করার অভিপ্রায়ে ষড়যন্ত্র গোপন করলে ১০ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ড ভোগ করবে।’ দণ্ডবিধির ১২৩(ক) ধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র সৃষ্টির নিন্দা করা ও উহার সার্বভৌমত্ব বিলোপ সমর্থন করলে বা সেই মর্মে প্রচারণা চালালে দশ বৎসর পর্যন্ত সেই ব্যক্তিকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।’
দণ্ডবিধির ১২৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো আইনানুগ ক্ষমতা প্রয়োগে বাধ্য করা বা বাধাদান করার অভিপ্রায়ে রাষ্ট্রপতি, গভর্নর প্রমুখ ব্যক্তিকে আক্রমণ করলে সেই ব্যক্তি সাত বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবে’।”
গত ৪ ফেব্রুয়ারি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা-ডিজিএফআইয়ের দেওয়া সংবাদ ছাপানোর কথা স্বীকার করে মাহফুজ আনাম বলেন, ‘যাচাই-বাছাই না করে তা প্রকাশ করা ছিল বিরাট ভুল।’