পরিবেশ ও বন বাঁচানো আমার পক্ষে অসম্ভব : বনমন্ত্রী
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।
আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর আগাঁরগাওয়ে বন ভবনে আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ মন্তব্য করেন মন্ত্রী।
এবারের বন্যপ্রাণী দিবসে মূল প্রতিপাদ্য ছিল- ‘আমরাই পারি বন্যপ্রাণী বাঁচাতে।’ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ।
এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুস আলী। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে মূল প্রতিপাদ্য উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বাঘ গবেষক মনিরুল এইচ খান। আলোচক ছিলেন উপপ্রধান বন সংরক্ষক (পিএলআর) তপন কুমার দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আনোয়ারুল ইসলাম প্রমুখ। দেশে বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তি রোধে করণীয় ও তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীবিদরা।
আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, ‘এই সেমিনারে এসে আজ এক ঘণ্টা ধরে জ্ঞান অর্জন করলাম। বাঘ শিকার একটি বীরত্বের ব্যাপার। আমরা দেখেছি বাঘ শিকার করে মৃত বাঘের ওপর দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে। তাহলে কয়েকশ বছর লাগবে যা শিখেছি আমরা তা ভুলে যেতে। আর এখন আমার সিসিএফ (প্রধান বন সংরক্ষক) সাহেব বলছেন বাঘ শিকার করা যাবে না। এই দিবস জাতিসংঘের স্বীকৃত। আমি বাঘ এলাকার মানুষ। যে হারে দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে, তাতে কী সম্পদ লাগবে, কী ধরনের মানুষ লাগবে, কী ধরনের অস্ত্র-শস্ত্র লাগবে এইগুলো ঠিক করা প্রয়োজন।’
বনমন্ত্রী বলেন, ‘মঠবাড়িয়ার সুন্দরবনের সীমান্ত দিয়ে আমি গাড়ি চালিয়ে যেতে দেখেছি ছোট ছোট বাড়িঘর। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ বাঁচবে না বাঘ বাঁচবে? রাস্তাঘাট থাকবে না গাছ থাকবে। যত রাস্তাঘাট আমি করেছি তত গাছ কাটতে হয়েছে। এখন সরকার মহাসড়ক চার লেন করতে চাচ্ছে, তাতে আরো গাছ কাটবে।’
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, ‘আমি অনেক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলাম। কিন্তু এই মন্ত্রণালয়ের এসে আমি নিজেই মনে করি আমার পক্ষে এই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা সম্ভব হবে না। কারণ আমরা সেমিনারে এসে বলি বাঘ মারবেন না, পাখি মারবেন না। কিন্তু আমি আমার মামার সঙ্গে পাখি মারতে গিয়েছি। আমাদের পক্ষে বন্যপ্রাণীর জন্য অভয়ারণ্য করা সম্ভব না। কারণ ৫৫ হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট একটি দেশে মানুষের সংখ্যা ১৬ কোটি। তাই যদি হয় আজ থেকে ৫০ বছর পর পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী কী বলবেন? বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কী সিদ্ধান্ত নিবেন, বলবেন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজন নাই।’
পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মন্ত্রণালয়ের সীমাবদ্ধতার তথ্য তুলে ধরে বলেন, ‘আমাদের সরকারের ধারণা হলো বিদেশি টাকায় চলবে বন ও পরিবেশ রক্ষার কাজ। দেশি টাকায় সম্ভব তা আমরা এখন প্রথম জানলাম। বিদেশিরা যখন আসে তখন বলে তোমার প্রতিষ্ঠান নেই, প্রশিক্ষণ নেই। এগুলো করতে করতে আমাদের মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। আমি যখন প্রথম মন্ত্রী হই, তখন দেশের বাজেট ছিল ৩০ হাজার কোটি টাকা আর এখন তিন লাখ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বরাদ্দের দিক থেকে তা অপ্রতুল। ফলে আমাদের গাছ লাগাতেও বিদেশি ফান্ডের প্রয়োজন। গাছ লাগাতে বরাদ্দকৃত অর্থ প্রকল্পের জন্য গাড়ি, বাড়ি কিনতেই শেষ। আমরা অনেক চ্যালেঞ্জিং অবস্থায় আছি। যখন বঙ্গবন্ধু সেতু হয় সেখানে একটা বাগান ছিল, এখনো আছে। আগে সেখানে কিছু ছিল না, এখন লাখ লাখ লোক রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। কারণ সেখানে রাস্তাঘাট-কলকারখানা হয়ে গেছে। এলাকাটি ছোট হয়ে গেছে। তাই অভয়ারণ্য আমি দেশবাসীকে দিতে সক্ষম হব না এবং আমার পরে যাঁরা (মন্ত্রী) আসবেন তাঁরা বলবেন, আমি এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকব না।’
অনুষ্ঠানে বন সংরক্ষক অসিত রঞ্জন পাল স্বাগত বক্তব্যে বলেন, সারা বিশ্বে বর্ধিত জনসংখ্যার চাপ, বন উজাড়, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস, দ্রুত নগরায়ন, জলাভূমি জবরদখল, পরিবেশ দূষণ, নির্বিচারে বন্যপ্রাণী পাচার ও নিধনের ফলে অনেক প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে।
বন্যপ্রাণীর আন্তর্জাতিক চিত্র তুলে ধরে অসিত রঞ্জন পাল বলেন, সারা পৃথিবীতে বর্ধিত জনসংখ্যার চাপ, বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচার, বন এবং বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস, বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবসা ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে, অনেক প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে। সিআইটিইএসের ২০০৮ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৪৪ হাজার ৪৩৮ প্রজাতির মধ্যে ১৬ হাজার ৯২৮টি হুমকির সম্মুখীন, ৮৬৯টি বিলুপ্ত, তিন হাজার ২৪৬টি মহাবিপন্ন, আট হাজার ৯১২টি বিপন্ন, তিন হাজার ৭৯৬টি সংকটাপন্ন, পাঁচ হাজার ৭৭০টির তথ্য অপর্যাপ্ত ও ১৭ হাজার ৬৭৫টি হুমকির সম্মুখীন নয়।
প্রাণীবিদ মনিরুল এইচ খান মূল প্রতিপাদ্য উপস্থাপন করে বলেন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে ৩ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজার্ভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) উদ্যোগে জাতিসংঘের ৮০টি সদস্য দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সিআইটিইএসের সনদ অনুমোদিত হয়। এই সনদে ৩৪ হাজার প্রাণী ও উদ্ভিদকে বর্তমানে সংরক্ষণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ২৩ ডিসেম্বর ২০১৩ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভায় ৩ মার্চকে ‘বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস’ ঘোষণা করা হয়। এ দিবসের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বন্যপ্রাণী সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, বন্যপ্রাণীর আবাস্থল সংরক্ষণের জন্য বিশ্ববাসীকে সোচ্চার করে তোলা।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, পৃথিবীতে বন্যপ্রাণী ও দেহাবশেষ পাচারের পরিমাণ মাদকদ্রব্য, অস্ত্র ও সোনা চোরাচালান একই পর্যায়ে চিহ্নিত হয়েছে। দাঁত ও সিংয়ের জন্য দাঁতাল হাতী ও গন্ডার মারা হচ্ছে; চামড়া ও হাঁড়ের জন্য বাঘ মারা হচ্ছে; মাংসের জন্য হরিণ ও পাখি মারা হচ্ছে। ফলে বন্যপ্রাণীর রেড লিস্ট দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
ইন্টারপোলের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে ১০ থেকে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের বন্যপ্রাণীর ট্রফি, হস্তিদন্ত, চামড়া, হাঁড়, মাংস, জীবিত বন্যপ্রাণী, বন্যপ্রাণী থেকে আরোহিত সনাতনী ওষুধ ও বিলাসবহুল দ্রব্যাদি পাঁচার হচ্ছে। যার ফলে বেশির ভাগ বন্যপ্রাণীর সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।
বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে বন্যপ্রাণী সংরক্ষকরা জানান, এক সময় প্রাণী বৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল বাংলাদেশ। গত কয়েক দশকের ব্যবধানে এখান থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে- একশিঙা গন্ডার, বারশিঙা, প্যারা হরিণ, রাজ শকুন, গোলাপি শির হাঁস, বাদি হাঁস, মিঠা পানির কুমির, হক্স বিল্ড টারটাল ইত্যাদি। ২০১০ সালে ড. আলী রেজা খান ওয়াইল্ডলাইফ অব বাংলাদেশ : এ চেকলিস্ট বইতে এক হাজার ৫৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর তালিকা দিয়েছেন। তার মধ্যে ৪২টি উভচর, ১৫৭ সরীসৃপ, ৭৩৬টি পাখি ও ১২৪টি স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। তবে এতে মৎস্য প্রজাতিসমূহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
সেমিনারে আলোচকরা বলেন, দক্ষিণ এশিয়া পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এলাকা। বন্যপ্রাণী ও তাদের আবাস্থল সংরক্ষণের লক্ষ্যে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আইনের সঠিক প্রয়োগ ও বন্যপ্রাণীর ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের লক্ষে বাংলাদেশ একাধিক আন্তর্জাতিক প্রটোকল ও চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বন বিভাগের ওপর ন্যস্ত থাকলেও দক্ষ জনবল, অবকাঠামো ও বাজেটের স্বল্পতার কারণে বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে বিরল, বিপন্ন বন্যপ্রাণীর পাচাররোধ ও শিকার বন্ধ করার যৌথ উদ্যোগ নিতে হবে।