সামনে বৈশাখী মেলা তাই ব্যস্ত কার্তিকপুর
কিছুদিন পরেই ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ থেকেই শুরু এ মেলার। মেলায় পাঠাতে হবে হরেক রকমের খেলনা আর শত ধরনের পণ্য। আর তাই ঘুম হারাম হয়ে গেছে কার্তিকপুরের মৃৎপল্লীর পাল সম্প্রদায়ের সকল বয়সের নারী-পুরুষ ও শিশুর। পুরো গ্রামজুড়ে চলছে এখন বাহারি সব উপকরণ তৈরির মহা উৎসব।
লাখো টাকা উপার্জনের নেশায় এখন অন্য কোথাও মন দেওয়ার সুযোগ নেই এসব শিল্পী পরিবারের সদস্যদের। তবে চৈত্রের বৃষ্টিতে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এসব মানুষ।
শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম কার্ত্তিকপুর। মৃৎশিল্পের জন্য এ গ্রামের সুখ্যাতি বহু আগে থেকেই। বলা চলে ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ খ্যাতি। এ গ্রামের পাল বংশের লোকদের আদি পেশা মাটি দিয়ে নানা রকমের খেলনা, ঘর গৃহস্থালির বিভিন্ন তৈজসপত্র, টালি, মটকা, হাঁড়ি, পাতিল, বদনাসহ আধুনিক শত শত প্রকারের মৃৎপণ্য বানানো। বংশপরম্পরায় এ কাজ করে আসছে কুমার বা পালেরা। এই এলাকার উৎপাদিত শিল্প সম্ভার আজ সমাদৃত হয়েছে ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের ২০টি দেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে। দেশের অভ্যন্তরে আড়ং, কারিতাস, হিড হ্যান্ডিক্রাফটসসহ বিভিন্ন খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান কার্তিকপুর থেকে মাটির তৈরি পুতুলসহ সকল পণ্য সংগ্রহ করে থাকে।
সরেজমিনে মৃৎপল্লী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বৈশাখী মেলার জন্য কুমাররা তৈরি করছেন পুরোনো খেলনাসহ অনেক পণ্য। কার্ত্তিকপুরের পালদের মৃৎ কারখানায় তৈরি হচ্ছে মাটির টেরাকোটা, টাইলস, মোমদানি, ফুলদানি, ফুলের টব, নাইট ক্যান্ডেল, কয়েন বাক্স, টব, ওয়াল প্লাস্টার, ওয়াল টব, কলমদানি, ভিজিটিং কার্ড বাক্স, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের নেইটি বেইটি হাউস, মা মেরির মূর্তি, ক্রিসমাস হ্যাংগিং রিং, গার্ডেন টপ, হোয়াইট ক্যান্ডেল, আগরদানিসহ অন্তত তিন হাজার ধরনের শো পিস। এসব পণ্য তৈরি করার জন্য এসব পরিবারের লোকদের বাইরে পাশের আরো তিনটি গ্রামের বিভিন্ন বয়সের কয়েকশত শ্রমিক কাজ করছেন। এর মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। শ্রমিকরা জানালেন, বছরের পুরো সময় ধরেই মৃৎপল্লীতে কাজ থাকলেও অতিরিক্ত চাপ পরে ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে।
এ বছর চৈত্র মাসের শুরু থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি আর মেঘলা আবহাওয়ার কারণে শেষ সময়ে এসে মাটির পণ্য তৈরি ও সরবরাহে কিছুটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অসময়ের বৃষ্টির কারণে অনেক পণ্য ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
মৃৎশ্রমিক আলাউদ্দিন মিয়া ও শিখা রানী মণ্ডল বলেন, ‘আমরা বছরের পুরো সময় ধরেই পালদের হরেক রকমের পণ্য তৈরি করে সংসার চালাই। তবে ফাল্গুন মাস থেকে বৈশাখী মেলার জন্য কাজের চাপ পরে। এই সময় আমরা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কাজ করে দৈনিক পাঁচশত থেকে সাতশো টাকা উপার্জন করি।’
মৃৎশিল্প মালিক প্রদীপ কুমার পাল, চন্দন পাল, সুধীর চন্দ্র পাল, উত্তম কুমার, রূপক কুমার পাল ও বিপ্লব কুমার পাল বলেন, ‘বংশপরম্পরায় আমরা মাটির পণ্য তৈরি করছি। এক সময় শুধু ঘর-গৃহস্থালির তৈজসপত্র তৈরি হতো। এখন আমরা শত শত প্রকারের আন্তর্জাতিক মানের শো পিস তৈরি করি। আমাদের উৎপাদিত পণ্য এখন দেশের বাইরেও রপ্তানি করে থাকি। বৈশাখী মেলা সামনে রেখে এখন পরিবারের সবাইকে নিয়ে রাত দিন আমরা ব্যস্ত সময় পার করছি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মেলায় পণ্যগুলো সঠিক সময় পৌঁছে দেওয়ার জন্য। তাঁরা আরো জানান, সম্পূর্ণ নিজেদের বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা এই পণ্যগুলো নির্মাণ করে থাকি। আমাদের কাছে কোনো আধুনিক প্রযুক্তি নেই। এমনকি সরকারের কোনো সহায়তাও পাই না আমরা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমরা আরো অনেক দূর এগোতে পারতাম।’
শরীয়তপুর বিসিক শিল্পনগরীর উপব্যবস্থাপক মো. মুনির হোসেন বলেন, ‘কার্তিকপুরের ঐতিহ্যবাহী মৃৎপল্লীর সুনাম রয়েছে অনেক কাল আগে থেকেই। এই সব শিল্প-উদ্যোক্তারা আমাদের কাছে সহায়তা চাইলে আমরা তাদের আর্থিক সহায়তা থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তিগত সকল ধরনের সরকারি সহায়তা প্রদান করব।’