প্রধান শিক্ষককে সরাতে বিরাট ষড়যন্ত্র মঞ্চস্থ হয়েছে
নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে শ্যামল কান্তি ভক্তকে তাঁর পদ ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি। প্রধান শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় স্থানীয় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানসহ ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে পুরো ঘটনার জন্য বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটিকে জবাবদিহিতার আওতায় আনারও দাবি জানিয়েছেন।
আজ বুধবার নারায়ণগঞ্জ শহরের বালুর মাঠে সংগঠনের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জোনায়েদ সাকি এ কথা বলেন।
urgentPhoto
জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘যাঁরা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন তাঁদের বিচার হওয়ার কথা, সেখানে প্রধান শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে। অবিলম্বে সেই স্কুল কমিটিকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হোক। শ্যামল কান্তিকে স্বপদে বহাল করতে হবে, সব নিরাপত্তা রাষ্ট্রকে দিতে হবে। এর মধ্যে একটা সাম্প্রদায়িক মাত্রা দেওয়ার চেষ্টা এ অপরাধকারীদের মধ্যে আমরা দেখতে পেয়েছি।’
জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘সমস্ত সরকারই ক্ষমতা ধারণ করে। যাঁদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত আছে, তাঁরা তাঁদের ক্ষমতার দাপট বিভিন্নভাবে দেখিয়ে যাচ্ছেন। এর নির্লজ্জ উদাহরণ ঘটেছে এই নারায়ণগঞ্জে। এখানকার এমপি, তিনি জাতীয় পার্টির হলেও মূলত তিনি সরকারের সমর্থনপুষ্ট এবং তিনি যে পরিবারের সদস্য; মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তিনি সে পরিবারের সঙ্গে আছেন। যাঁর বিরুদ্ধে শিশুহত্যা থেকে শুরু করে বহু খুনের অভিযোগ আছে, আমরা দেখেছি সে পরিবারের বিচার না করে, বিচার প্রক্রিয়া অগ্রসর না করে খোদ প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, তিনি ওই পরিবারের সঙ্গে আছেন, তখন তা জাতির জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। সেই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আমরা একের পর এক ঘটতে দেখেছি। কেননা সেই শক্তির জোরেই আজকে তাঁরা এমন দাপট দেখাচ্ছেন যে আজ একজন প্রধান শিক্ষককে জনসম্মুখে কান ধরে ওঠ-বস করানো হচ্ছে।’
সাকি আরো বলেন, ‘পুরো ঘটনার প্রথম অংশ হচ্ছে এই যে প্রচারণা করা হয়েছে, তিনি নাকি ধর্মের বিরুদ্ধে কটূক্তি করেছেন। আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই, তিনি যদি ধর্মের বিরুদ্ধে কটূক্তি করে থাকেনও তাহলে আইন অনুযায়ী তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তাঁকে কান ধরে ওঠ-বস করানো, জনসম্মুখে তাঁকে অপমান করার অধিকার কোনো ব্যক্তির থাকতে পারে না। সেলিম ওসমান কেন, নারায়ণগঞ্জের কোনো কর্মকর্তা এমনকি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীরও এ ক্ষমতা থাকতে পারে না কাউকে প্রত্যক্ষভাবে তিনি শাস্তি প্রদান করবেন, বিচার ছাড়া। সংবিধানে যে ন্যূনতম মানবিক মর্যাদার কথা বলা হয়েছে, ন্যূনতম মানবিক অধিকারের কথা আছে, সে অধিকার হচ্ছে প্রত্যেক ব্যক্তির বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সে অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে, তার ব্যতিরেকে কোনোভাবে তাঁর মর্যাদা বা তাঁকে শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। কাজেই সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে সেখানে।’
প্রচারণার বিষয়টি উল্লেখ করে সাকি আরো বলেন, ‘যে প্রচারণা করা হয়েছে যে ধর্মের বিরুদ্ধে কটূক্তি করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ডাহা মিথ্যা। এখানে মূলত ওই প্রধান শিক্ষককে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজেদের লোককে বসানোর জন্য একটা বিরাট ষড়যন্ত্র মঞ্চস্থ করা হয়েছে। মসজিদের ইমামের বা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই মাইক ব্যবহার করে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ওই ইমাম এবং ছাত্র বলেছেন, ধর্মের বিরুদ্ধে কোনো কটূক্তি তিনি করেননি। তারপরও এ রকম একজন শিক্ষক যিনি দীর্ঘদিন ধরে স্কুলের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে পরিচালনায় বিরাট ভূমিকা পালন করে আসছেন, যিনি ওখানে একজন সম্মানিত শিক্ষক, ছাত্রদের মাঝে জনপ্রিয় এবং একজন সৎ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত, তাঁকে ছাত্রদের ও এলাকাবাসীর সামনে যেভাবে অপমান করা হলো, আজ সংবাদপত্রে দেখলাম নারায়ণগঞ্জ এসেই তিনি বলেছেন, আমি আজ মৃত। তাঁকে যেভাবে হেনস্তা করা হয়েছে তা খুনের চেয়ে কম নয়।’
তদন্ত কমিটির সমালোচনা করে জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, তদন্ত কমিটি করেছেন। কাকে দিয়ে তদন্ত কমিটি করলেন? নারায়ণগঞ্জের শিক্ষা কর্মকর্তাকে দিয়ে। তিনি নিজে ওই ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন এবং তিনি নিজে ওই ঘটনায় একজন দায়ী ব্যক্তি। তিনি প্রতিবাদ করেছেন বলে এখন পর্যন্ত কোনো বক্তব্য আমরা পাইনি। কাজেই ওই ঘটনার তিনি অংশ হিসেবে ছিলেন। তিনি যখন তদন্ত কমিটি হন, আমরা দেখতে পাচ্ছি তদন্ত কমিটি একটা ধামা হিসেবে ঘটনাকে চাপা দেওয়া হচ্ছে।’
জোনায়েদ সাকি ও সংগঠনের অন্য নেতারা শহরের খানপুরে ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে অসুস্থ শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে দেখতে যান। এ সময় শ্যামল কান্তি সংগঠনের নেতা সাকির কাছে সেদিনের বিষয়টি তুলে ধরেন।
এ সময় শ্যামল কান্তি ভক্ত জানান, বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি তাঁর অযোগ্য বোনকে প্রধান শিক্ষক বানানোর জন্যই এই পুরো ঘটনা সাজিয়েছেন। তিনি তাঁর ওপর হামলা ও লাঞ্ছনার শাস্তি দাবি করে বলেন, একজন শিক্ষককে, একজন মুক্তিযোদ্ধাকে যে দেশে এভাবে জনসমক্ষে অপমানিত হতে হয়, প্রহৃত হতে হয়, সেই দেশে কোনো মানুষই তো আর মর্যাদা নিয়ে বাস করতে পারবে না।
জোনায়েদ সাকি শ্যামল কান্তি ভক্তকে বলেন, সমগ্র বাংলাদেশ তাঁর পাশে আছে। তিনি সরকারের প্রতি প্রশ্ন করে বলেন, এই ঘটনার নায়ক সেলিম ওসমানকে এখনো কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না? তাঁর বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ তো পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতেই দেখা যাচ্ছে। মন্ত্রীরা মুখে যত কথাই বলুক না কেন, দেশবাসী জানে সরকার ওসমান পরিবারকে রক্ষা করারই প্রাণপণ চেষ্টা করবে। ত্বকী হত্যাকাণ্ডে এদের জড়িত থাকার কথা প্রমাণিত হওয়ার পর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে এই পরিবারের পক্ষে থাকার ওয়াদা করেছিলেন। এই সমর্থন ওসমান পরিবারকে আরো বেপরোয়া এবং উদ্ধত করেছে। শ্যামল কান্তি ভক্তকে বরখাস্ত করার আদেশ যে এখনো বহাল আছে, সেটাও প্রমাণ করে যে, সরকার ও প্রশাসন ওসমান পরিবারের মাফিয়াতন্ত্রেরই পৃষ্ঠপোষক। এমনকি পুরো ঘটনাকে এখন একটি সাম্প্রদায়িক চেহারা দিয়ে পুরোনো কায়দাতেই তা অন্য খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু গোটা দেশের মানুষ শ্যামল কান্তি ভক্তের পাশে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করেছেন যে, সরকার ও তাদের মাফিয়া গডফাদারদের প্রচারণায় জনগণ আর সহজে প্রতারিত হতে রাজি নয়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম, আরিফুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ জেলা গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক তরিকুল সুজন, গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন দাশ, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল বাপ্পী প্রমুখ।