চেয়ারম্যান ভয়ংকর

Looks like you've blocked notifications!

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার বিচারিক হাকিম একটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন চেয়েছিলেন উপজেলার লতাচাপলি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আবু সায়েদ ফকিরের কাছে। চেয়ারম্যান কোনো প্রতিবেদন জমা না দিয়ে নিজেই সালিস করেন। এক কিশোরী ও তার দুলাভাইকে ভয়াবহ শাস্তি দিয়েছেন। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে তিনটি পরিবার। 

লতাচাপলি ইউনিয়নের একাধিক বাসিন্দা জানান, গত মাসে ইউনিয়নের ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরীর সাথে তার চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে হয়। কিন্তু কিশোরী সংসার করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ নিয়ে কিশোরী ও তার স্বামীর পরিবারে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। পরে কিশোরীর দুলাভাই তাকে স্বামীর বাড়ি থেকে বরগুনায় নিজের পরিবারের কাছে নিয়ে যান। এ ঘটনায় কিশোরীর বাবা গত ২৫ মার্চ কলাপাড়া বিচারিক হাকিম আদালতে বড় মেয়ের জামাইয়ের বিরুদ্ধে একটি অপহরণের মামলা করেন। আদালত লতাচাপলি ইউপির চেয়ারম্যানকে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। চেয়ারম্যান আবু সায়েদ ফকির ২৯ মার্চ আদালতের ওই নির্দেশনামা গ্রহণ করেন। তিনি তদন্ত না করে ওই দিন বিকেলে ইউপি হলরুমে সালিস বসান। 

সালিসে উপস্থিত একাধিক ব্যক্তি জানান, সালিসে আবু সায়েদ ফকির ছাড়াও ইউপি সদস্য সোহরাব হোসেন, সাবেক মহিলা ইউপি সদস্য মিনারা বেগম, কুয়াকাটা পৌর ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক তৈয়বুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁরা দাবি করেন, কিশোরীর সাথে তার দুলাভাইয়ের অনৈতিক সম্পর্ক ছিল। এ কারণে তিনি ওই কিশোরীকে স্বামীর বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেছেন। 

এলাকার একাধিক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সালিসে আবু সায়েদের রায়ে ওই কিশোরীকে ৩০ বার বেত্রাঘাত করা হয়। ইউপি সদস্য সোহরাবের ফেলা থুতু চেটে খেতে বাধ্য করা হয়। অন্যদিকে কিশোরীর দুলাভাইয়ের পুরুষাঙ্গে ইট বেঁধে হলরুমে ঘোরানো হয়। জরিমানা করা হয় ২৫ হাজার টাকা। 

এ ছাড়া সালিসে ওই কিশোরীর বিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়। তার স্বামীকে ডেকে বিবাহবিচ্ছেদের কাগজে সই করানো হয়। একই সাথে কিশোরীর বড় বোনের চার বছরের সংসার জীবন আগামী এক মাসের মধ্যে স্থায়ীভাবে ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দেন আবু সায়েদ ফকির। 

গতকাল বুধবার সরেজমিনে দেখা গেছে, শ্রমজীবী দরিদ্র কিশোরীর পরিবার নিজ বাড়িতে অবরুদ্ধ হয়ে আছে। তারা ছিল ভীত-সন্ত্রস্ত। দিনের বেলাও দরজা বন্ধ করে ছিলেন। ঘটনার আট দিন পরও বেত্রাঘাতে আহত কিশোরী সুস্থ হয়ে ওঠেনি। কথা বলতে গিয়ে ব্যথায় কুঁকড়ে যায় সে। চোখে-মুখে ছিল আতঙ্কের ছাপ। 

কিশোরী জানায়, তার দুলাভাইয়ের সাথে কোনো অনৈতিক সম্পর্ক নেই। একটি পক্ষ মিথ্যা কথা ছড়িয়ে এসব করিয়েছে। তাদের সালিসের রায় মানতে বাধ্য করেছে প্রভাবশালীরা। অন্যের থুতু খেতে বাধ্য করা হয়েছে। চিকিৎসা নিতে গেলে বাধাও দেওয়া হয়েছে। 

কিশোরীর বাবা মেয়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেওয়ার আবেদন করেছেন। এ খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে সালিসের লোকজন আরো অত্যাচার করবে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।

কিশোরীর ওই দুলাভাইকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিন বছরের মেয়েসন্তান নিয়ে তাঁর স্ত্রী জানান, ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় পড়ে গেছেন তিনি। প্রভাবশালীদের পরবর্তী নির্যাতনের ভয়ে তাঁর স্বামী পালিয়ে গেছেন।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান আবু সায়েদ ফকির এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘কিশোরীর বাবা-চাচা বিচার চেয়েছেন, তাই বিচার করেছি।’ 

আদালতের নির্দেশ না মেনে সালিস করা প্রসঙ্গে আবু সায়েদ বলেন, ‘সব বিচার আইনসঙ্গতভাবে করা যায় না।’ 

তবে কিশোরীর বাবা জানান, তাঁরা চেয়ারম্যানের কাছে কোনো বিচার চাননি। তাঁরা ভুল বুঝে বড় মেয়ের জামাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন।

ইউপি সদস্য সোহরাব হোসেন বলেন, ‘অনেক মানুষ বিচারে উপস্থিত ছিল। তাঁরা দেখেছে,  চেয়ারম্যান  আমাকে থুতু ফেলতে বলেছে তাই ফেলেছি।’ সাবেক ইউপি সদস্য মিনারা বেগমের বাড়িতে গেলে তাঁর পরিবারের লোকজন জানান, তিনি বাড়িতে নেই। 

কলাপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো.আজিজুর রহমান জানান, তিনি বিষয়টি জেনেছেন। খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে জানান, ওই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে রোববার তাঁর কার্যালয়ে হাজির করতে তিনি ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সাথে ওসিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করে আদালতের নির্দেশ যাচাই-বাছাই করতে বলেছেন। একই সাথে আদালতকে ঘটনা জানিয়ে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ চাইতে ওসিকে বলেছেন।