জঙ্গি হামলা, আস্থার সংকটে প্রবাসীরা

৯ জুলাই শনিবার, বিকেল ৩টা। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দর। ফ্লাইট থেকে নেমে ইমিগ্রেশনে ভিসাসহ পাসপোর্ট জমা দিতেই দায়িত্বরত কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হোটেল বুকিংয়ের কাগজ কোথায়?’ এর আগে আরো কমপক্ষে পাঁচবার সিঙ্গাপুরে আসা আমার কাছে প্রশ্নটি ছিল একেবারেই নতুন। বাংলাদেশ থেকে ভিসা নিয়ে যাওয়া পর্যটকদের কাছে সাধারণত হোটেল বুকিং চাওয়া হয় না এখানে!
হোটেল বুকিং নেই জানাতে ওই কর্মকর্তা পাঠিয়ে দিলেন খানিকটা দূরে থাকা ইমিগ্রেশনের ইন্টেলিজেন্স ডেস্কে। সেখানে পাসপোর্ট, টিকেটসহ আনুষঙ্গিক কাগজপত্র নিয়ে একটি নম্বরসংবলিত কার্ড ধরিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হলো অপেক্ষমাণ কক্ষে। ছোট ওই কক্ষে দেখা মিলল আরো প্রায় ৮-১০ জন বাংলাদেশির। উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে আছেন সবাই। সেখানে অন্যান্য দেশের নাগরিক খুব একটা নেই বললেই চলে। মিনিট বিশেক বসার পর ডাক পড়ল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দপ্তরে। প্রায় ১৫ মিনিট চলল জিজ্ঞাসাবাদ। একপর্যায়ে অনেকটা অধৈর্য হয়ে বললাম, ‘আমি তো এর আগেও বহুবার এসেছি তোমাদের দেশে, কখনো তো এমন হয়নি, তাহলে এখন কেন হয়রানি করছো?’ উত্তরে ওই কর্মকর্তা বললেন, ‘পরিস্থিতি কি আছে আগের মতো? বদলে গেছে।’
আসলেই বদলে গেছে। বদলে গেছে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের অবস্থা। স্বাভাবিক চলাফেরা থেকে কর্মস্থল এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্য, কোথাও আর নেই আগের মতো পরিস্থিতি। গুলশানের হলি আর্টিজানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর বিদেশিদের কাছে মুহূর্তে যেন বদলে গেছে বাংলাদেশের পরিচিতি। সেই সঙ্গে আস্থা হারিয়েছে বিদেশে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। সবাই এখন কেমন যেন এড়িয়ে চলতে চায় তাদের।
সিঙ্গাপুরের চায়না টাউনে কথা হয় সেখানে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত বাংলাদেশের ছেলে এম এম পলাশের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আপনি শিক্ষিত। ভালো ইংরেজি বলেন। যে কারণে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের লোকজনকে সামাল দিতে পেরেছেন। যারা পারে না তাদের অবস্থাটা একবার ভাবুন। দেশ থেকে ভিসা নিয়ে সিঙ্গাপুর বিমানবন্দর পর্যন্ত এসে প্রতিদিনই দু-চারজন করে আবার ফেরত যাচ্ছে। সামান্য এলোমেলো কিংবা সন্দেহ হলেই তাদের আর সিঙ্গাপুরে ঢুকতে দিচ্ছে না চাঙ্গি ইমিগ্রেশন।’
রবার্টসন লেনের দোকান কর্মচারী বরিশালের গৌরনদীর যুবক নাজির হোসেন বলেন, ‘সিঙ্গাপুরের স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে বরাবরই ভালো সম্পর্ক এখানে কর্মরত বাংলাদেশিদের। কিন্তু গুলশান এবং শোলাকিয়ার ঘটনার পর এখন অনেকেই এড়িয়ে চলেন আমাদের। কেমন যেন আস্থা আর ভরসা খুঁজে পাই না তাদের আচরণে।’ সেরাঙ্গুন এলাকায় কথা হয় বরিশালের শিপন হামিদুর রহমানের সঙ্গে। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে যিনি আছেন সিঙ্গাপুরে। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এমন অবস্থা এর আগে আর কখনো দেখিনি। অন্যান্য দেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের অবস্থা জানি না, সিঙ্গাপুরে অনেকটা বেশি মাত্রায় অস্বস্তিতে আছি আমরা। তার ওপর এখানে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চার বাঙালির কারাদণ্ড হওয়ায় আরো বেশি আস্থা হারিয়েছে বাংলাদেশিরা।’ সিঙ্গাপুরের গণমাধ্যমগুলোও ব্যাপক গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করছে বাংলাদেশের জঙ্গি ইস্যুবিষয়ক খবরগুলো। ১১ জুলাই সিঙ্গাপুরের প্রভাবশালী দৈনিক স্ট্রেইট টাইমস বাংলাদেশের হলি আর্টিজানের ঘটনা নিয়ে প্রকাশ করে ছবিসংলিত বিশাল একটি প্রতিবেদন। পত্রিকাটির ‘এশিয়া’ পাতায় ওয়াশিংটন পোস্ট অবলম্বনে প্রকাশিত ওই নিবন্ধে জঙ্গি ইস্যুতে বাংলাদেশের নড়বড়ে অবস্থানের কথা উল্লেখ করে পত্রিকাটি। এর ঠিক একদিন পর বেশ বড় করে ছাপা হয় সেখানে চার বাংলাদেশির কারাদণ্ডের খবর।
কেবল সিঙ্গাপুর নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত চীন এবং বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পর্যটক ভ্রমণের দেশ থাইল্যান্ডেও আগের আস্থার জায়গাটিতে নেই বাংলাদেশিরা। থাইল্যান্ডের বিষয়টি অবশ্য বাংলাদেশ থেকেই টের পেতে শুরু করে সেখানে বেড়াতে যেতে ইচ্ছুক বাংলাদেশিরা। মোটামুটি বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা না থাকা লোকজনকে এখন আর সহজে ভিসা দিচ্ছে না ঢাকার থাই দূতাবাস। বরিশালের তিন ব্যবসায়ী জানান, পরপর দুইবার আবেদন করার পরও ভিসা দেয়নি ঢাকার থাই কর্মকর্তারা। রাজধানীর ধানমণ্ডি এলাকার এক ট্রাভেল ব্যবসায়ী জানান, এর আগে একাধিকবার ব্যাংকক ভ্রমণ করা লোকজনকে পর্যন্ত ভিসা না দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
গত ১৪ জুলাই বিকেলে ব্যাংককের সুবর্ণভূম বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর খানিকটা ভয় ছিল সিঙ্গাপুরের ইমিগ্রেশনের অভিজ্ঞতার। তবে সে রকম কিছুই হয়নি। খুব সহজেই তাদের দেশে ঢুকতে দিল সুবর্ণভূম ইমিগ্রেশন। ব্যাংককের সুকুম্ভিত এলাকার ১১ নং সড়কের হোটেল ব্যবসায়ী নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘প্রায় ২৫ বছর ধরে আছি এখানে। এমন গুমোট পরিস্থিতি আর দেখিনি। দেশে একের পর এক জঙ্গি ঘটনায় নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের। কেমন যেন আড়চোখে তাকায় তারা।’
পর্যটনকেন্দ্র পাতায়ার ব্যবসায়ী জামাল হোসেন বলেন, ‘আগে বাংলাদেশিদের পাশাপাশি বিভিন্ন বিদেশিরাও খেতে আসত আমার হোটেলে। হলি আর্টিজানের ঘটনার পর কমতে শুরু করেছে সেই সংখ্যা। এখানকার থাই নাগরিকরাও কেমন যেন এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে আমাদের।’ পাতায়ার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী সোহাগ তালুকদার বলেন, ‘প্রতি মুহূর্তে দেশ নিয়ে টেনশনই তো এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। তা ছাড়া সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে বিশ্বব্যাপী দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে এটা তো মিথ্যে নয়। এখানে আমরা বাংলাদেশি কমিউনিটির যারা আছি তারা কেউ-ই ভালো নেই। দেশে একের পর এক জঙ্গি হামলার ঘটনায় আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবকিছুতেই প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে যেসব বাঙালিরা বিদেশি মালিকদের অধীনে চাকরি করে তারা আছে মহা সংকটে। এখন আর তাদেরকে বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না মালিকরা।’
তেমন কোনো বড় সমস্যা না হলেও চীনে যেসব বাংলাদেশি বর্তমানে ব্যবসা করতে যাচ্ছেন কিংবা থাকছেন সেখানে তারা আছেন অন্য জটিলতায়। গত ১২ জুলাই রাতে চীনের গুয়াংজু শহরের সানি ইয়ালী এলাকায় কথা হয় ঢাকার চকবাজারের ব্যবসায়ী সামছু উদ্দিনের সঙ্গে। এনটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনলেই নানা প্রশ্ন করেন চীনা ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে জানতে চায় সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার বিষয়ে। কেবল আমি নই, এখানে মালামাল আমদানি করতে আসা প্রায় সব ব্যবসায়ীকেই পড়তে হয় এমন অপ্রীতিকর অবস্থায়।’ তবে এত কিছুর পরও চীনে ঢোকা কিংবা বেরুনোর ক্ষেত্রে কোনোরকম জটিলতা পোহাতে হয়নি গুয়াংজু বিমানবন্দরে। খুব ভালোভাবেই তাদের দেশে ঢুকতে ও বেরুতে দিয়েছে চীনের গুয়াংজু বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন।
পানফুলু এলাকায় ঢাকা গেস্টহাউস নামে একটি আবাসিক হোটেল পরিচালনা করেন মুন্সীগঞ্জের যুবক হাসান। তিনি বলেন, ‘আগে তেমন কোনো টেনশনে থাকতে হয়নি আমাদের। কিন্তু দেশে একের পর এক জঙ্গি হামলার ঘটনার পর এখানে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের ওপর বেড়েছে পুলিশের নজরদারি। কিছুদিন আগে বাংলাদেশিদের পরিচালিত অনেকগুলো গেস্টহাউস একসঙ্গে বন্ধ করে দিয়েছে এখানকার কর্তৃপক্ষ। প্রকাশ্যে কিছু না হলেও আমরা বুঝি যে গোপনে আমাদের ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে চীনা পুলিশ। আর এর সবকিছুই শুরু হয়েছে গুলশানের ঘটনার পর।’