প্রশিক্ষণ ছাড়াই চলছে লঞ্চ-স্পিডবোট
পিনাক-৬ লঞ্চডুবি ট্র্যাজেডির দুই বছর পূর্তি ছিল ৪ আগস্ট। ২০১৪ সালের ওই দিনে ভয়াবহ এ লঞ্চডুবির পর দেশের নৌ খাতে আমূল পরিবর্তনের ঘোষণা দেয় নৌ মন্ত্রণালয়। কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তনও ঘটে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ নৌরুটে। এ ক্ষেত্রে নানা ধরনের সুপারিশ করা হলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি খুব একটা। সেই সঙ্গে আজো লঞ্চ ও স্পিডবোট চালকদের জন্য নেওয়া হয়নি যথাযোগ্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।
সুপারিশের প্রথম শর্ত ছিল, যাত্রী নিয়ন্ত্রণে পন্টুন থেকে কাটা হবে টিকেট। কিন্তু তা আজো মানা হয় না। শুধু তাই নয়, বেশির ভাগ লঞ্চই চলছে সুকানি (ইঞ্জিনচালক) দিয়ে। সুকানিদের ছয় মাস মেয়াদি অস্থায়ী অনুমোদনও দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাই। লঞ্চে জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জামের ব্যবহারও হতাশাজনক। স্পিডবোটগুলোতে লাইফ জ্যাকেট বাধ্যতামূলক হলেও চালকদের নেই কোনো প্রশিক্ষণ। ফলে দুর্ঘটনার চরম ঝুঁকি রয়েই গেছে।
রাজধানী ঢাকার সঙ্গে স্বল্প দূরত্বের কারণে দেশের গুরুত্বপূর্ণ কাওরাকান্দি-শিমুলিয়া নৌরুটটি গত ১০ বছরে দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ২০ বছর আগে এ রুটে শুরু হয় ফেরি সার্ভিস। এরপর পর্যায়ক্রমে লঞ্চ ও স্পিডবোট আসে। বর্তমানে এ রুটে ৮৭টি লঞ্চ, ১৮টি ফেরি ও আড়াই শতাধিক স্পিডবোট চলছে। যাত্রী ও নৌযান বাড়লেও ছিল না তদারকি। যার ফলে ২০১৪ সালে ঈদুল ফিতরের পরে মাওয়া ঘাটের কাছে পিনাক-৬ লঞ্চডুবিতে ৪৯ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক যাত্রী নিখোঁজ হন। এর পর সরকার নড়েচড়ে বসে, ঘোষণা আসে আমূল পরিবর্তনের। সব ঘাটে লঞ্চ ও স্পিডবোটে যাত্রী নিয়ন্ত্রণে নিয়োগ দেওয়া হয় টার্মিনাল ইন্সপেক্টর। কিন্তু পিনাক-৬ ডুবির তদন্ত কমিটির সুপারিশে উল্লেখিত জনবল আজো নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
এ রুটের কোনো স্পিডবোট চালকের নেই কোনো সার্টিফিকেট বা প্রশিক্ষণ। নৌরুটজুড়ে রয়েছে মাছ ধরার অবৈধ বাঁধ। নদীতে নেই কোনো নৌ-পুলিশ। তবে সুখের বিষয়, বৈরী আবহাওয়া হলে বন্ধ করে দেওয়া হয় লঞ্চ ও স্পিডবোট। স্পিডবোট যাত্রীদের দেওয়া হয় লাইফ জ্যাকেট। যদিও এর মান নিয়ে যাত্রীদের প্রশ্ন রয়েছে। এত সব সংশয়ে পড়ে যাত্রীরা এখন অনেক সচেতন। অনেক যাত্রীই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ফেরিতে পাড়ি দিচ্ছেন পদ্মা নদী। ফেরিতে ভিড় এখন অনেক বেশি। ঈদের আগে-পরে প্রশাসনও কঠোর থাকে লঞ্চ ও স্পিডবোটের ক্ষেত্রে।
লঞ্চযাত্রী শওকত হোসেন বলেন, এ রুটের লঞ্চগুলোতে নামমাত্র জীবনরক্ষাকারী বয়া রাখা হয়, যা কি না যাত্রীদের তুলনায় খুবই কম।
আরেক যাত্রী হুমায়ুন বলেন, ‘লঞ্চ মাস্টার চালাচ্ছে না সুকানি চালাচ্ছে, তা আমরা কীভাবে বুঝব। আমরা তো জানি মাস্টাররাই কেবল লঞ্চ চালায়।’
লঞ্চের ইনল্যান্ড মাস্টার ওলিয়ার রহমান বলেন, এ রুটে চলাচলকারী ৮৭টি লঞ্চের মধ্যে কয়েকটিতে লঞ্চ শুধু ইনল্যান্ড মাস্টার দিয়ে চালানো হয়। বাকি লঞ্চগুলো সুকানি দিয়ে চালানো হয়। তবে সুকানি সনদে তাদের ছোট লঞ্চ চালানোর অস্থায়ী অনুমতি আছে।
বেশ কয়েকজন সুকানি বিষয়টি স্বীকার করে জানান, তাঁরা ছয় মাস করে অনুমোদন নিয়ে লঞ্চ চালান।
স্পিডবোট চালক হুসাইন বলেন, ‘আমরা যাঁরা স্পিডবোট চালাই, তাঁদের সবাই দেখে দেখেই চালানো শিখেছি। আমাদের কারোরই কোনো প্রশিক্ষণ নেই। কীভাবে স্পিডবোট চালালে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব, তা আমরা জানি না। তাই সরকারিভাবে যদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়, আমাদের জন্য খুব ভালো হয়।’
বিআইডব্লিউটিএ কাওরাকান্দি ঘাটের টার্মিনাল পরিদর্শক এ বি এস মাহমুদ বলেন, ‘পিনাক-৬ লঞ্চডুবির এ রুটসহ বিভিন্ন রুটে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। পরে নৌপরিবহন অধিদপ্তর থেকে প্রতিটি লঞ্চের মাস্টার ও চালকদের প্রয়োজনীয় সনদ দেওয়া হয়েছে। সুকানিরা ছয় মাসের অনুমোদন সাপেক্ষেই লঞ্চ চালাচ্ছে। আমরা ঘাটে অবস্থান করে সার্বক্ষণিক লঞ্চের প্রয়োজনীয় কাগজ, ওভারলোডিং, জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জামসহ সব বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইমরান আহমেদ বলেন, ‘এ রুটে ৬৫ ফুটের নিচে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করতে বলা হয়েছে। অধিকাংশ লঞ্চ সুকানি দিয়ে পরিচালিত হয়। এখানে মাস্টার নিয়োগ করা উচিত। প্রয়োজন নৌ-পুলিশও। আর স্পিডবোটগুলোর চালকদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। চালকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে ভালো হয়।’
পিনাক-৬ লঞ্চডুবির তদন্ত কমিটির প্রধান ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নূর-উর রহমান বলেন, ‘পিনাক-৬ লঞ্চডুবির পর আমরা যেসব সুপারিশ করেছিলাম, তার অধিকাংশই বাস্তবায়ন হওয়া উচিত। বেশিরভাগই বাস্তবায়ন পর্যায়ক্রমে হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ নৌযান চলাচল যে অধ্যাদেশ রয়েছে, তা-ও সংশোধনে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ নৌরুট আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি নিরাপদ।’