ঈদের আনন্দ চাপা পড়ল বিস্ফোরণে, আগুনে
সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল খাদিজা বেগমের (২৭)। ছেলেমেয়েরা নতুন কাপড়চোপড় গুছিয়ে ব্যাগে ভরে রেখেছে। তাদের চোখেমুখে ঈদের আনন্দ। তাদের বাবা রাতের শিফটে কাজ সেরে বেতন নিয়ে ফিরলেই রওনা হবেন গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর মঠবাড়িয়ার পথে। এ কারণে ছেলেমেয়েরা ঘুম থেকে উঠে পড়েছে সকালেই। খাদিজাও বাড়ি যাওয়ার শেষ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আর স্বামীর ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন।
স্বামী আল-মামুন গতকাল শুক্রবার রাতে কাজে যাওয়ার সময় স্ত্রী খাদিজা বেগমকে বলে গিয়েছিলেন, ‘আজ কারখানায় ঈদের বেতন আর বোনাস দেবে। সবাই তৈরি হয়ে থেকো। ফিরে এসেই একটু খেয়ে বাড়ির পথে যাব। সকাল সকাল বের হতে না পারলে পথে দুর্ভোগ পোহাতে হবে।’
কিন্তু আজ শনিবার সকালেই স্বামীর জন্য অপেক্ষায় থাকা খাদিজা খবর পান তাঁর স্বামী যে কারখানায় কাজ করেন গাজীপুরের টঙ্গীর বিসিক এলাকার সেই ‘ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড’-এ বয়লার বিস্ফোরণের পর আগুন ধরে গেছে। আশপাশের মানুষের সঙ্গে তিনি সব কিছু ফেলে দৌড়ে ছোটেন কারখানার দিকে।
খাদিজা বেগম গিয়ে দেখেন শুধু আগুন আর আগুন। কিছু পরেই তিনি জানতে পারেন, সেই আগুন ‘খেয়ে ফেলেছে’ তাঁর স্বামী আল-মামুনকে। টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের সামনে খাদিজা বিলাপ করে বলছিলেন, ‘আজ গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যাওয়ার কথা ছিল। এখন স্বামীর লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে।’
শুধু খাদিজা বেগম নন, বয়লার বিস্ফোরণে ঈদের আনন্দ ‘আগুনচাপা’ পড়েছে এ কারখানার আরো শতাধিক শ্রমজীবী পরিবারের। যাঁরা রাতে বা সকালের শিফটে ওই কারখানায় কাজ করতেন।
সেখানেই এ ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ রাশেদের (২৮) বোন ফারজানা কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, তাঁর ভাই রাশেদ ভোরে রিকশা নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। তার পর থেকে তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। টঙ্গী বিসিক এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে তিনি সেখানে ছুটে যান। সেখানে গিয়ে রাশেদের বন্ধু খালেকের কাছে জানতে পারেন রাশেদ রিকশা নিয়ে ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় বয়লার বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হন। এর পর থেকে তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
ফারজানার মতোই স্বজনের খোঁজে টঙ্গী হাসপাতালের সামনে অপেক্ষা করছেন কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার বাসিন্দা নিখোঁজ রফিকুল ইসলামের (২৫) স্ত্রী নার্গিস আক্তার, সিরাজগঞ্জের শাহাদাতপুর উপজেলার নিখোঁজ ইসমাইল হোসেনের (২৩) ভাই রফিকুল ইসলাম, টঙ্গীর গোপালপুর এলাকার নিখোঁজ আনিছের (৩০) বাবা সুলতান হোসেন, একই এলাকার মাঈন উদ্দিনের ভাতিজি সুলতানা ও ভগ্নিপতি মোস্তফা, রংপুরের ভুরুঙ্গামারী থানার নিজাম উদ্দিনের ছেলে ইদ্রিস আলীর (২৭) বোন সাবিনাসহ অনেকে।
আজ শনিবার ভোরে গাজীপুরের টঙ্গীর রেলগেট এলাকায় ফয়েল তৈরির কারখানা ‘ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড’-এ বয়লার বিস্ফোরিত হয়ে সর্বশেষ ২৪ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক মানুষ। আগুনে ভবনটি ধসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কারখানা ভবনের পাশের আরো দুটি ভবন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদর দপ্তর, টঙ্গী ও জয়দেবপুরের ১৯টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে যোগ দেয়।
কাজে ছিলেন ৩০০ জন
গাজীপুর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক আক্তারুজ্জামান জানান, কারখানায় শনিবার সকাল পর্যন্ত নাইট শিফটের কাজ চলছিল। এখানে প্যাকেজিং ও প্লাস্টিকের প্যাকেট এবং ফয়েল তৈরি করা হয়। প্রতি শিফটে ৩০০ জন করে তিন শিফটে শ্রমিকরা কাজ করতেন। রাতের শিফটের কাজ শেষ হওয়ার আগেই শনিবার সকাল ৬টার দিকে কারখানার নিচতলায় হঠাৎ বিকট শব্দে পরপর দুটি বয়লার বিস্ফোরিত হয়। এতে কারখানার কিছু অংশসহ পাশের দেয়াল ভেঙে দূরে ছিটকে পড়ে এবং কারখানায় আগুন ধরে যায়।
কারখানায় ফয়েল ও প্লাস্টিকজাতীয় দাহ্য জিনিস থাকায় ও বাতাসের কারণে মুহূর্তেই আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে কারখানার পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় কর্মরত শ্রমিকদের অনেকে কারখানা থেকে বের হয়ে আসতে পারলেও বেশ কয়েকজন ভেতরে আটকা পড়েন। অগ্নিকাণ্ডে পাঁচতলা ওই কারখানা ভবনের একাংশের চারটি তলা ধসে যায়। এতে কারখানার বেশ কয়েককর্মী ধ্বংস স্তূরের নিচে চাপা পড়ে এবং অগ্নিদগ্ধ ও আহত হয় বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা।
খবর পেয়ে টঙ্গী, জয়দেবপুর, উত্তরা, কুর্মিটোলা, সদর দপ্তর, সাভার, ইপিজেড, কালিয়াকৈর, শ্রীপুর, মিরপুরসহ ফায়ার সার্ভিসের আশপাশের বিভিন্ন স্টেশনের ১৯টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নেভানো ও হতাহতদের উদ্ধারের কাজ শুরু করে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সঙ্গে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরাও অংশ নেন। হতাহতদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পাঠানো হয়। আগুনে ঘটনাস্থল ও টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে ১৯ জন আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঁচজন নিহত হয়।
টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মো. পারভেজ মিয়া জানান, প্রথমে দগ্ধ ও শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে মৃত দুজনকে হাসপাতালে আনা হয়। পরে মৃত অবস্থায় আরো সাতজনকে আনা হয়। আহতদের মধ্যে ১০ জনকে টঙ্গী হাসপাতালে রেখে অন্যদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নিহতদের ময়নাতদন্তের জন্য লাশ শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হবে।
ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শঙ্কর পাল জানান, আহতদের মধ্যে তিনজন তাঁদের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। এর মধ্যে একজনের শরীরের ছয় ভাগ, আরেকজনের আট ভাগ পুড়েছে। দীপন নামে একজনের শরীরের ৯০ ভাগ পুড়ে গেছে, তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা জানান, বাতাসের কারণে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছে। কী কারণে বয়লার বিস্ফোরণ ঘটেছে, সে বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু জানা যায়নি।
হতাহতদের নাম-পরিচয়
নিহতদের মধ্যে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ১৯ জনের নাম ও পরিচয় জানা গেছে। এঁদের মধ্যে কারখানার অপারেটর জয়নাল আবেদিন (৩৭), অপারেটর আনোয়ার হোসেন (৪০), ক্লিনার শংকর সরকার (২৫), দারোয়ান রেদোয়ান (৩৫), নিরাপত্তাকর্মী জাহাঙ্গীর আলম (৫০), নিরাপত্তাকর্মী হান্নান মিয়া (৬৫), শ্রমিক সুলায়মান (৩০), প্রিন্টিং হেলপার রফিকুল ইসলাম (২৮), ইদ্রিস আলী (৪০), অপারেটর আল মামুন (৪০), নয়ন, শিফট ইনচার্জ সুভাষ চন্দ্র (৪০), প্রকৌশলী আনিসুর রহমান (৪০), রিকশাচালক জাহিদুল, রাশেদের লাশ রয়েছে টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে। আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে ওয়াহেদুজ্জামান (৪০), দেলোয়ার হোসেন (৩৫), আনোয়ার হোসেন (২৫) ও পথচারী আসমা আক্তার। এ ছাড়া অজ্ঞাত আরেকজনের লাশ রয়েছে ঢামেক হাসপাতালে।
এ ছাড়া গুরুতর আহতরা হলেন আসিফ, রোকন, দিলীপ চন্দ্র রায়, ফেরদৌস আলম, আবু সাঈদ, আকবর আলী, শহিদুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক, লিটন, মাহবুব, কামরুল ইসলাম, জাকির হোসেন, মিজানুর রহমান, নিজামউদ্দিন, শহিদুল, জাহাঙ্গীর আলম, শাহ আলম, মনোয়ার হোসেন, কামাল উদ্দিন, শাকিল আহমেদ ও সবুজ মিয়ার নাম জানা গেছে। এঁরা টঙ্গী সরকারি হাসপাতাল, টঙ্গীর আবেদা মেমোরিয়াল হাসপাতাল, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
হাসপাতালে স্বজনদের ভিড়
টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের নিচতলার এক পাশে গেট আটকানো। বাইরে উৎসুক জনতা। গেটের ভেতরে কয়লা হওয়া মরদেহগুলো আঁকা-বাঁকা হয়ে পড়ে রয়েছে। মরদেহের ওপর ছোট করে কাগজে লেখা, হোসাইন। ডাক্তারদের অনুমান, আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ বছর। মরদেহ আনার পর প্রথমে অজ্ঞাত হিসেবে পড়েছিল হোসাইন। অন্য একজনের মরদেহ শনাক্ত করতে এসে এক শ্রমিকের স্বজন তাঁকে শনাক্ত করেন। কিন্তু এর চেয়ে বেশি পরিচয় পাওয়া যায়নি। দুপুর ১২টা পর্যন্ত হোসাইনের কোনো স্বজনকে হাসপাতাল চত্বরে দেখা যায়নি।
হোসাইনের মতো আরো কয়েকজনের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে টঙ্গী হাসপাতালের বারান্দা ও সিঁড়ির নিচে। তাদের শনাক্ত করতে ভিড় করছেন স্বজনরা।
চার তদন্ত কমিটি
কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় পৃথক চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এসব তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
এর মধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক বদিউজ্জামানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ১০ কার্য দিবসের মধ্যে এই কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
বিসিকের পক্ষ থেকে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগুনের কারণ অনুসন্ধান, দায়দায়িত্ব নির্ধারণ এবং সুপারিশসহ কমিটির প্রতিবেদন আগামী সাতদিনের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়েছে।
কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে উপমহাপরিদর্শক মো. শামছুজ্জামান ভূইয়াকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
হতাহতদের অনুদানের ঘোষণা
বয়লার বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের প্রত্যেকের পরিবারকে দুই লাখ টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। দুপুরে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু এ তথ্য জানিয়েছেন।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ঘটনায় নিহত প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা এবং আহত প্রত্যেককে ১০ টাকা হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দেন জেলা প্রশাসক এস এম আলম।
কর্মকর্তাদের ঘটনাস্থল পরিদর্শন
বিস্ফোরণের পেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু, স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম আলম, গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন-অর-রশিদ, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র (ভারপ্রাপ্ত) আসাদুর রহমান কিরণ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) আনিস মাহমুদ, কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোশারফ, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. আজমত উল্লাহ খান, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তরের স্টেশন কর্মকর্তা সারোয়ার এ খান, শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার সোয়েব আহম্মেদ প্রমুখ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
গাফিলতি আছে কি না দেখা হচ্ছে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে শ্রমিক নিহতের ঘটনায় মালিকের কোনো গাফিলতি আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে দুপুরে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।
মন্ত্রী বলেন, ‘মামলা নিশ্চয়ই হবে। এতগুলো মানুষ মারা গেছে মামলা তো হবেই। তদন্তের পরে বোঝা যাবে যে মামলাটা কী কী ধারায় হবে।’