‘এ রকম চিন্তাও করি নাই’
আহমেদ রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়ের মতো সিলেটে গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস রিপনকেও উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীই হত্যা করেছে বলে দাবি করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। তবে বিজয়ের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, তাঁরা কোনোদিন ভাবতেও পারেননি এ রকম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটবে। কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাঁরা ধারণাও করতে পারছেন না।
সিলেট নগরীর সুবিদবাজারে নিজ বাসার সামনে আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে খুন হন বিজয়। কর্মস্থল রূপালী ব্যাংকে যাওয়ার পথে অজ্ঞাতপরিচয় দুর্বৃত্তরা ধাওয়া দিয়ে তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। স্থানীয় লোকজন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
বিজয় প্রসঙ্গে কথা হয় বড় বোন পঞ্চ ত্রপা দাসের সঙ্গে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘তার (বিজয়) গণ্ডিটাই হচ্ছে অফিস, বাসা। বাসায় কিছু রেসপনসিভিলিটি (দায়িত্ব) আছে। যেহেতু আমার ফাদার (বাবা) অসুস্থ, তাঁর কিছু রেসপনসিভিলিটি আছে। আর বাইরে মাঝে মাঝে যেত। ফোন দিলে হয়তো বলত আমি অমুক জায়গায় আছি বা আমি জিন্দাবাজারে আছি। যেহেতু লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু এদের কেউ আমাদের বাসায় কখনো আসে নাই।’
কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে- প্রশ্ন করা হলে বড় ভাই রত্মেশ্বর দাস বলেন, ‘এ রকম আসলে কোনো কিছু বলে নাই। আমরা আসলে চিন্তা করি নাই কোনো সময়। রিজার্ভ মানুষ ছিল। কোনো সময় এগুলো বলে নাই। এই মুহূর্তে কোনো কিছুই আমরা ট্রেস (ধারণা) করতে পারতেছি না।’
সিলেট ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে কথা হয় গণজাগরণ মঞ্চ সিলেটের মুখপাত্র দেবাশীষ দাস দেবের সঙ্গে। তিনি এনটিভিকে বলেন, ‘এটি তো একই কায়দায় আমরা দেখতে পাচ্ছি। যেভাবে অভিজিৎকে হত্যা করা হয়েছে, যেভাবে বাবুকে হত্যা করা হয়েছে, সেই একই কায়দায় অনন্ত বিজয়কে হত্যা করা হয়েছে। তিনি একজন ব্লগার ছিলেন। বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিলের সভাপতি ছিলেন। যুক্তি নামক বিজ্ঞানভিত্তিক একটি ছোট কাগজ সম্পাদনা করতেন তিনি। তাঁকে বিভিন্ন সময়ে এই বিজ্ঞানভিত্তিক লেখালেখির কারণে উগ্রবাদী গোষ্ঠী হুমকি দিয়ে আসছে। উগ্রবাদী গোষ্ঠীর যে হিটলিস্ট করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে সেখানেও তাঁর নাম ছিল। এ কারণেই তিনি একটা থ্রেটের (হুমকি) মধ্যে ছিলেন। আমরা হত্যার যে সিনড্রোম দেখতে পাচ্ছি সে ক্ষেত্রে ধারণা করাই যায়, সেই একই গোষ্ঠী, উগ্রবাদী গোষ্ঠীর হামলার শিকারই হয়েছেন তিনি।’
একই সময় একই হাসপাতালে সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সাধারণ সম্পাদক রজত কান্তি গুপ্ত বলেন, ‘যাদের হত্যা করা হচ্ছে এরা কিন্তু সাধারণ নয়। এরা কিন্তু ব্লগার এবং মুক্তবুদ্ধির চেতনার মানুষ এবং লেখালেখি করছেন।
তাঁদের লেখা থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়। এর আগেও কয়েকজন ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। তার ধারবাহিকতায় আজকে সিলেটে তাঁকে (অনন্ত বিজয়) হত্যা করা হলো এবং যারা হত্যা করছে তারা কিন্তু চিহ্ণিত শত্রু। আমরা বারবার বলে আসছি এই চিহ্নিত শত্রুকে রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করতে হবে এবং প্রত্যেক ব্লগার যাঁরা ব্লগে লেখালেখি করেন যাঁদের জীবন হুমকিস্বরূপ তাঁদের নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের দায়িত্ব এবং একই সাথে যারা এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের দ্রুত চিহ্ণিত করা প্রয়োজন।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী দাবি করেছে, বিজয় হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে এরই মধ্যে তারা কাজ শুরু করেছে। এর সাথে খুনিদের ধরতেও অভিযানে নেমেছে তারা।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার রহমত উল্লাহ বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৮টায় ঘটনাটি ঘটেছে। ঘটনাস্থলকে আমরা প্রিজার্ভ (সংরক্ষণ) করেছি। আলামত সংগ্রহ কার্যক্রম চলছে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলেছি।
তাঁরা আমাদের জানিয়েছেন, মুখোশধারী চারজন দুষ্কৃতকারী তাঁকে ধাওয়া করে। তিনি বাসা থেকে পূবালী ব্যাংকের কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। পথে তাঁকে ধাওয়া করে। বাসা থেকে ১৫০ গজ দূরে পুকুরপারে তাঁকে হত্যা করা হয়।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিলেটে র্যাব ৯-এ কর্মরত সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পঙ্কজ কুমার দে বলেন, ‘পেশাদার বলতে আপনারা কী দেখছেন? অভিজিত হত্যা, রাজীব হত্যা একই ধরনের হত্যাকাণ্ড। আমার কাছে যেটা মনে হচ্ছে অনেক দিন টার্গেট করেছে উনাকে (অনন্ত বিজয়)। যেহেতু উনি গণজাগরণ মঞ্চের একজন সংগঠক ও একজন ব্লগার। হয়তো উনার লেখনিতে কারো মনে হয়তো কষ্ট দিয়েছে। যে পরিপ্রেক্ষিতে উনাকে টার্গেট করছে একটি গ্রুপ হয়তো। দেখা যাক, আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নলেজে আছে ব্যাপারটা। সেন্ট্রালি (কেন্দ্রীয়ভাবে) এটা সুপারভাইস করা হচ্ছে। আমরা আশা করছি, যদি কিছু হয় তাহলে আপনাদের অবশ্যই অমরা ইনফর্ম করব।’
এ দিকে বিজয় হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছেন গণজাগরণ মঞ্চ ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা।