ছাদে চন্দ্রমল্লিকা, নয়নতারা আরো কত কী!
নির্ঝর, ৫৯, দেয়ানা, দৌলতপুর, খুলনা। পাঁচ কাঠা জমির ওপরে দুই হাজার ২০০ বর্গফুটের এক দোতলা বাড়ি। আর দশটা বাড়ির মতো দেখতে হলেও একে আলাদা করে দিয়েছে ছাদ। কংক্রিটের আস্তরের ওপর এক টুকরো নির্মল প্রকৃতি, চমৎকার বাগান।
বাগানে এখন অজস্র বাহারি ফুলের ছড়াছড়ি। গোলাপি, লাল, হলুদ, সাদা ও বেগুনি চন্দ্রমল্লিকার দীর্ঘ সারির পাশাপাশি গাঁদা, ডালিয়া, গোলাপ, বেলি, ক্রিসেনথিমাম, কসমস, ইয়োলোবেল, ট্রকুমা, রঙ্গন, ভেলভেট, দোপাটি, নয়নতারা, ইডিয়াম, বাগানবিলাসসহ (বোগেনভোলিয়া) সুদৃশ্য ক্যাকটাস ও পাথরকুচি ফুলের বৈচিত্র্য। ছাদের অন্যদিকে ঝুলন্ত ফুলের বাহার।
ছাদের কিনারা ঘেঁষে চমৎকার টমেটো বাগানটি। কোনো কীটনাশক বা স্প্রে ছাড়াই দিব্যি এতে ফলের অফুরান সম্ভার। ৬০ ফুট দীর্ঘ ও দেড় ফুট প্রস্থের এই টমেটো বাগানের বেডটি তৈরি করা হয়েছে ছাদ থেকে দেড় ফুট উঁচুতে ঢালাই বেঞ্চির ওপরে। এতে করে ছাদের কোনো ক্ষতি যেন না হয়, তা নিশ্চিত করা গেছে। বেডে মাটি প্রস্তুতের সময় প্রচুর প্রাকৃতিক সার ও পরিমাণমতো সরিষার খৈল ব্যবহার করা হয়েছে। পরে গাছের পরিচর্যায় নিয়মিত খৈল পচানো পানি প্রয়োগ করা হয়েছে। আর এভাবেই প্রতিবছর প্রচুর টমেটো ফলেছে এ বাগানে। গেল বছরেই ফলন হয়েছে ১০০ কেজি! এবারের ফলনও খুব ভালো।
এই টমেটো থেকে পরিবারের প্রয়োজন মিটিয়েও আত্মীয়দের দিয়েছেন, আবার শীতের পরের সময়টুকুর জন্যও সংরক্ষণ করা হয়েছে বলে জানালেন বাড়ির মালিক মো. ইকবাল কবীর এবং তাঁর স্ত্রী সালেহা খাতুন। ১২ মাসই কোনো না কোনো জাতের ফুল ফোটে ছাদের ওপরে।
শুধু টমেটোই নয়, বর্ষার বাগান সুশোভিত হয় ঘন সবুজ বেদানার সারিতে অজস্র লাল ফুলে। শীত-পরবর্তী সবজির মধ্যে থাকে ঢ্যাঁড়স, পুঁইশাক, ডাঁটা শাক ইত্যাদি।
মো. ইকবাল কবীর পেশায় একজন ব্যবসায়ী। সালেহা খাতুন একজন চাকরিজীবী। পড়ালেখার পাট চুকিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। এখন কাজ করছেন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনে (এসডিএফ) রিজিওনাল মনিটরিং টিম লিডার হিসেবে। কর্মস্থল বাগেরহাট। একসময়ের শিক্ষাজীবনের এ দুই বন্ধু দাম্পত্য জীবনেও বন্ধুত্ব আর ভালোবাসায় সাজিয়েছেন তাঁদের ঘর। দুই ছেলে। বড় ছেলে মো. নাজমুস সাকিব সরকারি বিএল কলেজে ইসলামের ইতিহাস অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র এবং ছোট ছেলে মো. হাসানুর রাকিব খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র।
মো. ইকবাল কবির জানান, ছাদ-বাগানের শুরু তাঁর স্ত্রী সালেহা খাতুনের হাত ধরে, সেই ১৯৯৭ সালের কথা। প্রথমে শুধু ফুলের এবং পরে সবজির ও তার পাশাপাশি নানা রকম ফলেরও বাগান করেছেন। তাঁদের বাগানে ১৩টি বেদানা গাছ আছে, যা প্রতিবছরই ফল দেয়। এ ছাড়া আছে পেয়ারা, করমচা, লাল জামরুল, সাদা জামরুল, বারমাসি আমড়া, সিডলেস লেবু, কমলা ও আঙুরের গাছ—যার সব কটিতেই ফল ধরে।
সালেহা খাতুন জানালেন, বাগান তিনি শুরু করলেও তাঁর স্বামী মো. ইকবাল কবীর একসময়ে পরম মমতা ও যত্নে বাগানের পরিচর্যার সব ভার নিয়ে নেন। ইকবাল কবীরের নিরলস ও নিবিড় পরিচর্যার ফলে এত ফুল-ফসলের সমারোহ। ছুটির দিনগুলোতে দুজনে একসঙ্গে বাগানে কাজ করেন। ভোরে ও বিকেলের কফি খান ফুল ও পাখিদের কাকলিতে মুখরিত এই বাগানে বসেই।
পরিবেশ সচেতন এই দম্পতি বলেন, এখানকার আবাসিক এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা নানা ধরনের কারখানার ধোঁয়া আর ধূলিতে এলাকাটি ধীরে ধীরে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাটি হয়ে উঠছে বৃক্ষশূন্য। বেঁচে থাকার জন্য একটু বিশুদ্ধ বাতাস, যা একটি মানবিক অধিকার, তা আজ ভীষণভাবে বিপন্ন। মানুষের বাঁচার এই ন্যূনতম অধিকারটুকু যখন কিছু অসচেতন ও দায়িত্বহীন মানুষের কারণে ভয়ানকভাবে হুমকির সম্মুখীন, তখন তাঁদের এই কংক্রিটের ছাদের ওপর ফুল-ফসলের শ্যামল বাগানটি পরিবেশদূষণের বিরুদ্ধে এক বর্ণিল প্রতিবাদ।
এই দম্পতি আশা করেন, ‘শহরের প্রতিটি পরিবার যদি তাঁদের বাড়ির ছাদে এক টুকরো বাগান করবেন, এতে তাঁরা পেতে পারেন বিষমুক্ত ফলফলাদি ও সবজি। এ ছাড়া নির্মল আনন্দের পাশাপাশি বিপর্যস্ত এই পরিবেশও হয়ে উঠতে পারে আমাদের সন্তানদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার উপযোগী।’