স্বামী মারা গেছেন সমুদ্রে, রেখে গেছেন ঋণ

Looks like you've blocked notifications!
সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় নির্যাতনে ও অনাহারে মারা যাওয়া আনারুলের স্ত্রী কদভানু, সঙ্গে চার বছর বয়সী শিশু আশিক। ছবি : এনটিভি

মেহেরপুরে গত দুই বছরে আদম ব্যবসায়ীদের কারণে সর্বস্ব হারিয়েছে একাধিক পরিবার। এ সময়ের মধ্যে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে সমুদ্রপথে যাওয়া প্রায় ১১ জনের কোনো খোঁজ পাচ্ছে না তাঁদের পরিবার। সাগরপথে থাইল্যান্ড থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন একজন। 

মেহেরপুর সদর উপজেলার ঝাঁঝাঁ গ্রামের আনারুল ইসলাম ২০১৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর কক্সবাজার হয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া রওনা দেন। সঙ্গে একই গ্রামের আরো পাঁচজন ছিলেন। ২০১৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মুঠোফোনের মাধ্যমে আনারুলের স্ত্রী কদভানু খবর পান, আনারুল মারা গেছেন। থাইল্যান্ড থেকে নির্যাতনের শিকার আনারুল সাগরপথে মালয়েশিয়া আসার আগেই মারা যান। আনারুলের এক সঙ্গী কদভানুকে জানান, মালয়েশিয়ার এক জঙ্গলে কাগজে মুড়ে আনারুলের লাশ ফেলে দেয় পাচারকারীরা।

দিনমজুরি করে দিন খারাপ কাটছিল না কদভানু আর আনারুলের। কিন্তু আদম ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে স্বামীসহ সর্বস্ব হারিয়েছেন কদভানু। চার বছরের একমাত্র শিশু আশিককে নিয়ে এখন অনাহারে দিন কাটছে তাঁর।  হাল ধরার কেউ নেই সংসারে। নেই কোনো জমি-জায়গা। ভেঙে পড়া ঘরে এক টুকরো চাটাইয়ের বেড়া দেওয়ার সামর্থ্যও কদভানুর নেই। বিদেশ যাওয়ার জন্য স্বামীর রেখে যাওয়া প্রায় দেড় লাখ টাকা ঋণ কী করে পরিশোধ করবেন, তা ভেবে দিশেহারা তিনি। অর্থের অভাবে আইনের আশ্রয়েও যেতে পারছেন না ওই কদভানু।

সরেজমিনে ঝাঁঝাঁ গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, জরাজীর্ণ একটি কাঁচা ঘরের বারান্দায় একাই বসে আছেন কদভানু। স্বামীর খবরাখবর জানতে চাইলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি জানান, দিনমজুরের কাজ করে ভালোই চলছিল সংসার।

ইছাখালী গ্রামের সাদের আলী আর সিদ্দিক মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। তারা দুজন অপর দালাল গাংনী উপজেলার কসবা গ্রামের আব্বাস আলীর সহযোগী। তারা জানায়, মালয়েশিয়া যেতে মোট দুই লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হবে। এক লাখ টাকা নগদ দিতে হবে আর বাকি টাকা মালয়েশিয়া গিয়ে কাজ করে পরিশোধ করতে হবে। এ লোভনীয় প্রস্তাবে রাজি হয়ে গরু-ছাগল বিক্রি করে এক লাখ টাকা তুলে দেয় দালালের হাতে। এর পর তাঁর স্বামীকে গ্রামের আরো কয়েকজনের সঙ্গে ঢাকা নিয়ে যায়। একদিন পর সেখান থেকে কক্সবাজার হয়ে অবৈধভাবে নদীপথে থাইল্যান্ডে নিয়ে যায়।

ঝাঁঝাঁ গ্রামের আবদুস সালাম জানান, ওই সময় আনারুলের সঙ্গে দালালের প্রলোভনে পড়ে একই গ্রামের ছেলে হেকমত আলী (৫০), আসলাম (৪৫), ছেলে মজনু (৩৫), উজ্জ্বল আলী (৩৫) ও এরশাদ (৩৮)। তারাও এক লাখ টাকা করে দালালদের হাতে তুলে দেন। এর পর ২০১৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর আনারুলের সঙ্গে তাঁদের সবাইকে মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্য ঢাকা নিয়ে যায়।

তাঁদেরই একজন হেকমত আলী মুঠোফোনে যোগাযোগ করেন আনারুলের স্ত্রী কদভানুর সঙ্গে। হেকমতের কাছ থেকে কদভানু জানতে পারেন, সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাত্রার দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা। কদভানু এনটিভি অনলাইনকে বলেন, দালালদের নির্যাতন আর অনাহারে মারা যায় আনারুল। আনারুলদের একবেলা খাবার দেওয়া হতো।  এ খবর শুনে ধারদেনা করে বাকি টাকা দালালের হাতে তুলে দেন কদভানু। তিনি আরো জানান, পরে থাইল্যান্ড থেকে আবারো ২৭ দিন ধরে সাগরপথে মালয়েশিয়া নেওয়ার পথে তাঁর স্বামী মারা যান। লাশটি মালয়েশিয়া সীমান্তের একটি জঙ্গলের মধ্যে কাগজে জড়িয়ে ফেলে দেয় দালালরা। তাঁর সঙ্গে আরো একজনের লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে কদভানুকে জানান হেকমত।

ঝাঁঝাঁ গ্রামের বাসিন্দারা জানান, বৈধপথে এসব মানুষকে বিদেশ পাঠানোর কথা থাকলেও অবৈধভাবে সাগরপথে থাইল্যান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। তাঁরা মালয়েশিয়া পৌঁছালেও বর্তমানে সবাই শারীরিকভাবে অসুস্থ। ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। তাঁদেরই কয়েকজনের স্বজন জানান, যাঁদের খোঁজ পাওয়া যায়, তাঁদের জন্য এখনো টাকা পাঠাতে হয়।

ঝাঁঝাঁ গ্রামের বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলেন, দালাল আব্বাস আলী খুব প্রভাবশালী। আব্বাসের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারে না। মালয়েশিয়া যাওয়া ছেলেদের খোঁজ জানতে চাইলে উল্টো ভয়ভীতি দেখায়। আনারুলের স্ত্রী কদভানু টাকা ফেরত চাইলেও সে নানাভাবে হয়রানি করছে এবং ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আব্বাস আলী কাজ করছে ঢাকার আদম ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন নামের একজনের সঙ্গে। এ ব্যাপারে আব্বাসের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আদম ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন এভাবে বিদেশ পাঠানোর মূল হোতা। মহিউদ্দিনের বাড়ি যশোর জেলায়। শুধু ঝাঁঝাঁ গ্রামের নয়, বিভিন্ন গ্রামে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত এলাকায় দালাল লাগিয়ে একই ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে এভাবে বিদেশ পাঠানো হচ্ছে। আরেক আদম ব্যবসায়ী গাংনী উপজেলার খড়মপুর গ্রামের আহম্মদ আলী, এ উপজেলার খড়মপুর গ্রামের সাদাত আলীর ছেলে আসান আলী, একই গ্রামের জাকিরুল (৩৮), ওয়াসিম (২৩), কসবা গ্রামের জিয়াউর (৩৬), সানঘাটের সাইফুল (২২), পাকুড়িয়ার রুস্তুম (২৮), আড়পাড়ার মিনারুল (৩১) ও মেহেরপুর সদরের আমদহ গ্রামের লালনকে (২০) একই রকমের ফাঁদে ফেলে টাকা আদায়ের পর মালয়েশিয়া পাঠায় ২০১৩ সালে আগস্ট মাসে।