নারী নির্যাতন মামলার আসামির মুক্তির দাবি আ. লীগের!
নারী নির্যাতন ও আত্মহত্যার প্ররোচণার মামলায় আটক হয়েছেন সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার সোনাবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম। এর প্রতিবাদে কলারোয়া বাজারে মানববন্ধন করেছেন সংসদ সদস্য (এমপি) মুস্তফা লুৎফুল্লাহ, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা।
এমপি লুৎফুল্লাহর দাবি, চেয়ারম্যান মনিরুলকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে সোনাবাড়িয়া গ্রামের আফরোজা খাতুনের (১৬) পরিবারের। গত শনিবার সন্ধ্যায় নিজ বাড়িতে ওড়নায় প্যাঁচানো অবস্থায় আফরোজার লাশ উদ্ধার করা হয়। অভিযোগ ওঠে, চেয়ারম্যান মনিরুলের সালিশের কারণে এবং সালিশের পর ফেসবুকে ছড়ানো ছবি দেখার পর অপমানে আত্মহত্যা করে আফরোজা।
মনিরুলের মুক্তি দাবি!
সোমবার সকালে চেয়ারম্যান মনিরুলের মুক্তির দাবিতে কলারোয়া বাজারে আয়োজিত এক মানববন্ধনে জড়ো হন আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মী। ওই মানববন্ধনে বক্তব্য দেন তালা-কলারোয়া আসনের সংসদ সদস্য মুস্তফা লুৎফুল্লাহ, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ ফিরোজ কামাল শুভ্র, আরাফাত রহমান ও উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ স্বপন। সেই সঙ্গে যোগ দেন আটক সোনাবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলামের সমর্থকরা।
মানববন্ধনে কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমদাদ শেখের প্রত্যাহার দাবি করা হয়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মানববন্ধনে বলেন, নিরপরাধ চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে ওসি প্রকৃত অপরাধীদের ছাড় দিয়েছেন। মনিরুল ষড়যন্ত্রমূলক মামলার শিকার বলে দাবি করেন তাঁরা। এ সময় তাঁরা পুলিশের গ্রেপ্তার বাণিজ্যের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন করে তাঁরা অনতিবিলম্বে চেয়ারম্যান মনিরুলের মুক্তি দাবি করেন।
এদিকে আজ সোমবার কলারোয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কক্ষে আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠক হয়েছে। ইউএনও উত্তম কুমার রায়ের সভাপতিত্বে বৈঠকে এমপি মুস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেন, ‘কলারোয়ায় পুলিশের গ্রেপ্তার বাণিজ্য চরমে উঠেছে। পুলিশের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে নিজের ইউনিয়ন পরিষদে সমাবেশ করায় পুলিশের রোষানলে পড়েন সোনাবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. মনিরুল ইসলাম। এজন্য ওসি তাঁকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করেছেন।’
ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কলারোয়া থানার ওসি এমদাদ শেখ। তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যান মনিরুলকে সুনির্দিষ্ট মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখানে কোনো বাণিজ্য করা হয়নি।’
কান্না থামেনি আফরোজার বাড়িতে
এদিকে আফরোজার শোকে পাথর হয়ে যাওয়া মা আনোয়ারা বেগমের বিলাপ ভারী করে তুলেছে কলারোয়ার বাতাস। নিজ বাড়িতে দম বন্ধ করা পরিবেশে জিম্মি হয়ে পড়েছেন তাঁরা।
এদিকে মামলা করে এখন আত্মগোপন করেছেন আফরোজার ভাই ইব্রাহিম খলিল। তিনি জানিয়েছেন, মামলা করার পর চেয়ারম্যান মনিরুলের সমর্থকরা তাঁকে ধরে নিয়ে যায়।
ইব্রাহিম জানান, তাঁকে দিয়ে জোর করে অ্যাফিডেভিট করিয়ে বলা হয়েছে, ‘আমি মামলা করতে চাইনি। তা ছাড়া আমার বোনের মৃত্যুর জন্য চেয়ারম্যান দায়ী নন।’
সোনাবাড়িয়া ইউনিয়নের সোনাবাড়িয়া গ্রামের মনিরুলের লোকজনের সতর্ক পাহারা জিম্মি করে ফেলেছে নিহত আফরোজার দরিদ্র পরিবারকে। সংবাদকর্মীসহ কোনো লোক সে গ্রামে গেলে তাদের পিছু নিচ্ছে চেয়ারম্যানের লোকজন। তারা আফরোজার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে দিচ্ছে না।
শোকে পাথর হওয়া মা আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমার মেয়েটারে চেয়ারম্যান মেরে ফেলল। আল্লাহ তার বিচার করবে।’
আফরোজার প্রতিবেশী কোরবান আলী বলেন, ‘মেয়েটির হাত রশিতে বেঁধে চেয়ারম্যানের পরিষদে নিয়ে যেভাবে অপমান করা হয়েছে তাতে সে আত্মহত্যা না করে পারে না।’ তিনি প্ররোচণাকারীদের বিচার চান।
আফরোজার বোন খাদিজা খাতুন বলেন, ‘আমার বোনটিকে সালিশ বিচারের নামে জীবন দিতি হলো। চেয়ারম্যান ও তার সহযোগীরা যেন শাস্তি পায়।’
গ্রামের মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ফ্ল্যাক্সিলোড দিতে যাওয়া আফরোজাকে কৌশলে দোকানী হাসানের ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয় চেয়ারম্যানের লোক রাজু, হাফিজুল ও জিয়া। হাসানের মা সালেহা খাতুন সেই তালা ভাঙতে গিয়ে বাধা পান। চেয়ারম্যান আফরোজা ও পলাশকে ধরে নিয়ে যেতে বললে তারা তাদের রশিতে বেঁধে নিয়ে যায়। সালিশ বিচারের নামে চেয়ারম্যান মেয়েটিকে বকাবকি এমনকি মারধর করেন। তাকে তার সঙ্গে প্রেম করার কথাও বলেন। এরপর সে আত্মহত্যা করে।’
এদিকে আফরোজা ও পলাশকে ধরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করে তা ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সোনাবাড়িয়া ইউনিয়নের চৌকিদার ইসমাইল বলেন, ‘চেয়ারম্যান মেয়েটিকে বলেছেন তুই বাইরের লোকের সাথে কেন গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে প্রেম করতে পারিস না।’
গত শুক্রবার দুপুরে সোনাবাড়িয়ার আফরোজা খাতুন একটি দোকানে মোবাইল ফোনে ফ্ল্যাক্সি লোড দিতে যান। দোকানির সঙ্গে পলাশ নামের এক বহিরাগত যুবকের লেনদেন নিয়ে বাগবিতণ্ডা হয়। এ সময় টাকা না দিয়ে পলাশকে শায়েস্তা করতে দোকানি হাসান ও তার সহযোগীরা আফরোজা ও পলাশকে তার একটি ঘরে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে অসামাজিক কাজের অভিযোগ তোলে। পরে চেয়ারম্যান মনিরুল সালিশ বিচারের নামে পলাশের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে মেয়েটিকে গালাগাল করেন এবং বলেন, ‘আমার সঙ্গে প্রেম করিস না কেন।’ শনিবার সন্ধ্যায় আফরোজার লাশ পাওয়া যায়।