প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে টাইলস

Looks like you've blocked notifications!
বাসসে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে নেওয়া ছবি

ঢাকার কামরাঙ্গীরচর এলাকার একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ ও উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাওয়া প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সাশ্রয়ী ফুটপাত টাইলস তৈরি করেছেন। ‘প্লাস্টিক দূষণের সমাধান’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে আজকের বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে ‘পরিবেশ মেলা ২০২৩’-এ প্রদর্শনের মাধ্যমে এই প্লাস্টিক টাইলস আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে তৈরি এসব টাইলস ইতোমধ্যে ভারতে, মিশরে, কেনিয়াসহ অন্যান্য দেশে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানা গেছে।

প্লাস্টিক বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তর করা নাজির হোসেন আজ সোমবার (৫ জুন) বাসসকে বলেন, ‘আমি ইতোমধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করে এক হাজার টুকরা টাইলস তৈরি করেছি।...আমি খুবই আশাবাদী যে এই টাইলস বাণিজ্যিকভাবে কার্যকর হবে, কারণ এটি সিরামিক টাইলসের তুলনায় সাশ্রয়ী ও টেকসই।’

এই উদ্ভাবনটি দেশের বর্জ্য বিশেষজ্ঞদের একটি নতুন ধারণা দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। যারা প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্যে মরিয়া হয়ে টেকসই সমাধান খুঁজছেন যখন শুধুমাত্র ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৬৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

রাজধানীর কামরাঙ্গীচর এলাকায় হোসেন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক নাজির তার উদ্ভাবনকে বাস্তবে পরিণত করার কাজে সহায়তা করায় রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন সেন্টার (আরআইসি) নামের একটি বেসরকারি সংস্থাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।  

পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহায়তায় আরআইসি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীনে কামরাঙ্গীচর, লালবাগ, ইসলামবাগ ও শ্যামপুর এলাকায় সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রজেক্ট (এসইপি) নামে একটি পাইলট বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

এসইপির প্রকল্প সমন্বয়কারী জহির উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আমাদের প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো উন্নত, টেকসই ও আকর্ষণীয় প্লাস্টিক সামগ্রী উৎপাদনের জন্যে উৎপাদন ইউনিট গড়ে তোলার পাশাপাশি পরিবেশ বান্ধব পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে কমিউনিটি উন্নয়নে অংশগ্রহণ করা। তিনি বলেন, ‘পরিবেশ বান্ধব প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিগতভাবে নিশ্চিত করতে কমিউনিটিকে সাহায্য করার পাশাপাশি তারা প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে টাইলস, ইট এমনকি জ্বালানি তৈরির জন্যে নানা উদ্ভাবন নিয়েও কাজ করছেন।’

নাজির যিনি দীর্ঘদিন ধরে প্লাস্টিকের জিনিসের ছাঁচ এবং প্যাটার্ন তৈরি করে আসছেন, তিনি বলেন, ‘প্লাস্টিকের টাইলস সিরামিক টাইলসের তুলনায় সাশ্রয়ী এবং হালকা।’ তিনি আরও বলেন, ‘একদিন দেখলাম সিটি করপোরেশন আমার ওয়ার্কশপের সামনে মাটির টাইলস দিয়ে ফুটপাত তৈরি করছে...সেদিন আমি ভাবলাম, কেন আমি প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করে টাইলস বানানোর চেষ্টা করব না।’

নাজির জানান, তিনি স্থানীয় এনজিওর সঙ্গে তার ধারণা শেয়ার করেন এবং টাইলসের জন্যে ছাঁচ তৈরি করতে স্বল্প সুদে ঋণ নেন। নজরি আরও বলেন, ‘আমি প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ এবং আমার ভাগ্য পরীক্ষার চেষ্টা শুরু করি।’ তিনি ২৮০ থেকে ৩০০ গ্রাম ওজনের ১১/৭.৫ ইঞ্চি প্লাস্টিকের টাইলসের দাম ৪২ টাকা নির্ধারণ করেছেন, যা ঐতিহ্যবাহী সিরামিক টাইলসের চেয়ে সস্তা।’ 

নজির বলেন, ‘আমি দাম কম রেখেছি, যাতে প্রত্যেকে এমনকি গ্রামের লোকজনও এটি ব্যবহার করতে পারে।’

টাইলস তৈরির পর নাজির আরআইসির সহায়তায় গুণগত মান পরীক্ষার জন্যে এসব টাইলস বুয়েটে পাঠান। সেখান থেকে তিনি ইতিবাচক সার্টিফিকেট পান যে তার টাইলসগুলো বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম আকন্দ জানান, তারা উপকরণ যাচাইয়ের জন্যে ১২টি পরীক্ষা করেছেন এবং দেখেছেন যে প্রথম সংস্করণ হিসেবে পণ্যটির মান সামগ্রিকভাবে ভালো। তবে তিনি বলেন, ‘টাইলসকে আরও উন্নত করার সুযোগ রয়েছে। আরএনডির মাধ্যমে একটি পণ্যের উন্নয়ন ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।’

অধ্যাপক আবদুস সালাম আরও বলেন, ‘প্লাস্টিকের টাইলস সিরামিকের বিকল্প হবে না, তবে এটি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। হালকা ও টেকসই হওয়ায় মানুষ এটি তাদের ছাদে অথবা ফুটপাত ও ওয়ার্কশপে ব্যবহার করতে পারে।’

পৃথিবীতে সাত ধরনের প্লাস্টিক রয়েছে। তাই সব ধরনের প্লাস্টিকই টাইলস তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সব ধরনের মধ্যে এলডিপি, এইচডিপি ও পিপি বাজার মূল্যের কারণে টাইলস তৈরিতে বেশি কার্যকর।

আকন্দ বলেন, ‘নষ্ট হওয়ার পর প্লাস্টিক টাইলস রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে পুনরায় ব্যবহার করা যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্লাস্টিক টাইলস বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যবহার করার সম্ভাবনা রয়েছে, যদি উদ্যোক্তারা এটি ব্যাপক পরিমাণে তৈরি করতে পারেন।’

এসইপি প্রকল্প সমন্বয়কারী বলেন, ‘প্লাস্টিক বর্জ্যরে পুনর্ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে তারা এই টাইলসের নাম দিয়েছেন থ্রি আর (রিডিউস,রিইউজ ও রিসাইকেল) টাইলস।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এখন উদ্যোক্তা, উৎপাদনকারী ও সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে একটা সংযোগ তৈরির চেষ্টা করছি, যেন পুনর্ব্যবহৃত এসব টাইলস বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্লাস্টিকের টাইলসগুলো কংক্রিট বা মাটির টাইলসের চেয়ে বসানো আরও সহজ।’