অবহেলায় ঐতিহাসিক প্রাচীন নিদর্শন রোয়াইলবাড়ী দুর্গ

Looks like you've blocked notifications!
নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়ায় অবস্থিত ঐতিহাসিক রোয়াইলবাড়ী দুর্গ। ছবি : এনটিভি

ঐতিহাসিক রোয়াইলবাড়ী দুর্গে চলছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের খননকাজ। উঠে আসছে সুলতানি আমলের অনেক প্রাচীন নির্দশন। এভাবে খননকাজ চলমান থাকলে আরও বেশি কিছু পাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে বলে জানিয়েন প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

রোয়াইলবাড়ী দুর্গ নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়ায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক প্রাচীন দুর্গ। এটি উপজেলা সদর থেকে ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে বেতাই নদীর তীরে রোয়াইলবাড়ী আমতলা ইউনিয়নে অবস্থিত। কালের আবর্তে এই রোয়াইলবাড়ী দুর্গ হারিয়ে যায় মাটির নিচে। প্রায় তিন যুগ আগে আশির দশকে আবিষ্কৃত এ স্থাপনাটি ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে নথিভুক্ত করে। দুর্গটি সংরক্ষিত ঘোষণার পর ১৯৯১-৯৩ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এখানে খননকাজ পরিচালনা করে এবং দুর্গের ধ্বংসাবশেষ ছাড়াও দুটি ঢিবি আবিষ্কার করে। সে সময় মাটির টিবি খনন করে মোঘল আমলের কারুকার্য সংবলিত ইট দিয়ে গড়া একটি বারোদুয়ারি মসজিদ, এর আশপাশে প্রাসাদের চিহ্ন ও একটি সুড়ঙ্গ পথের সন্ধান পায়।

সুড়ঙ্গের পাশেই একটি বটগাছের নিচে কথিত নিয়ামত বিবির মাজার এবং ১২ হাত লম্বা ডেংগু মালের কবরস্থান। কিন্তু অজানা কারণে কিছু দিনের মধ্যেই খননকাজ বন্ধ করে দেয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। সে সময় শুধু একটি সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়ে এলাকাটিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তবে নির্মাণ করা হয়নি কোনো প্রাচীর কিংবা নেই কোনো কাঁটাতারের বেড়া। খননের পর থেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পাথরের ও কাঁচের পিলার।

সরকারিভাবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মাধ্যমে ঐতিহাসিক এসব নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য মাঝেমধ্যে কাজ শুরু হলেও মাঝপথে আবার থেমে যায়। তখন অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকে এ স্থাপনা। ফলে ভূমি দখল অযত্ন, অবহেলায় ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঐতিহাসিক এই নিদর্শন রোয়াইলবাড়ী দুর্গ হুমকিতে থাকে।

নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় রোয়াইলবাড়ী দুর্গখনন করে পাওয়া মূল্যবান পুরাকীর্তি। ছবি : এনটিভি

এলাকাবাসীর দাবি, রোয়াইলবাড়ী দুর্গ অবস্থিত এলাকাটি একটি পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা হয়ে উঠছে না। এতে মোটা অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

২০১৬ সালে খনন করে সংরক্ষিত বিভিন্ন কারুকার্য-সংবলিত ইট পাথরের অস্থায়ী প্রদর্শনী উপস্থাপন করা হয় সেখানে। তখনকার সময়ে সেখানে এই প্রদর্শনী ও খননকাজ পরিদর্শনে এসেছিলেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) আলতাব হোসেন। তিনি পরিদর্শনকালে এলাকাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে এলাকাটিকে পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার আশ্বাস দিলেও খননকাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তার কোনো অগ্রগতি হয়নি।

এদিকে ঐতিহাসিক রোয়াইলবাড়ি দুর্গ এলাকা দেখতে প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকরা এখানে আসছে। কিন্তু সম্ভাবনাময় এই পর্যটন এলাকাটিতে জেলা পরিষদ পাকা দুটি ছাতা আকৃতির বিশ্রামগার নির্মাণ করলেও এর আধুনিকায়নে আর কিছুই করা হয়নি। ফলে পর্যটকদের পড়তে হয় বিড়ম্বনায়।

সম্প্রতি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নতুন করে খননকাজ শুরু করে আরও বেশ কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন বারোদুয়ারি মসজিদের দক্ষিণ দিকে খুঁজে পায়। খুঁজে পায় দুর্গের ফটকের সন্ধান।

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের খননকাজ সহযোগী আনোয়ার হোসেনসহ এলাকার বয়োবৃদ্ধ এবং স্থানীয় অনেকেই মনে করেন, সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহর পুত্র নছরত শাহ এ অঞ্চলে বসবাসের সময় দুর্গটি তৈরি ও সম্প্রসারণ করেন। পরবর্তী সময়ে ঈশা খাঁ ও তাঁর পরবর্তী শাসকের আমলেও দুর্গ ব্যাপক সম্প্রসারণের কাজ করা হয়।

নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় রোয়াইলবাড়ী দুর্গখনন করে পাওয়া মূল্যবান পুরাকীর্তি। ছবি : এনটিভি

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা বলেন, প্রায় ৪৬ একর ভূমির উপর অবস্থিত পুরো দুর্গটি পূর্ব-পশ্চিম দিকে লম্বা ও প্রাচীর দ্বারা বিভক্ত। দুগের প্রাচীর নির্মাণে ইট ও পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া দুর্গ এলাকায় রয়েছে পাঁচটি বড় পুকুর, একটি প্রধান দরজা, বেশ কিছু প্রবেশদ্বার, সীমানা প্রাচীর এবং প্রাকৃতিক প্রাচীর ছাড়াও বেশ কিছু প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ। খননকাজ পরিচালনাকালে এখানে প্রাচীন ইটের ভংগ্নাংশ, মৃৎপ্রাত্র, মূর্তি ও মূল্যবান কিছু পুরাকীর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে।

আফরোজা খান মিতা আরও বলেন, গেল ১০ এপ্রিল থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি দল রোয়াইলবাড়ীর ডেঙ্গু মিয়ার সমাধিস্থলে কাজ ধরে। কাজ চলাকালীন মাটির গভীরে পাওয়া যায় সুরঙ্গ পথ, সুলতানি আমলের ধাতব খণ্ড, ধাতব রিং, চুড়ির ভগ্নাংশ, রোদে শুকানো মাটির থালা, চুনা পাথরসহ আরও অনেক কিছু। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখনও অনেক খননকাজ বাকি। আরও ভালো কিছু পাওয়ার আশা করছেন তাঁরা।

সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) চন্দন কুমার দে সুলতানি আমলের প্রাচীন এই নির্দশনটি পরিদর্শন করেন।

মহাপরিচালক বলেন, ‘এই প্রাচীন নির্দশনটিতে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। আরও ভালো কিছু পাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। দেশের মানুষের কাছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিদর্শনগুলো তুলে ধরার জন্য স্থানীয়দের সহযোগিতায় আমাদের এ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’