ভৈরব মৎস্য অবতরণকেন্দ্র এখন গলার কাঁটা!
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মৎস্য অবতরণকেন্দ্রটি কিছুতেই চালু করা যাচ্ছে না। ২৭ শতাংশ ভূমির উপর নির্মাণ করা তিন তলা ভবনের এই কেন্দ্রটি এখন গলার কাঁটা হয়ে আটকে আছে।
সরকার রাজস্ব না পাওয়ার পাশাপাশি এত বড় ভবনের বিদ্যুৎ বিল, রক্ষণাবেক্ষণ এবং একজন কর্মকর্তাসহ দুজন কর্মচারীর বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ভবনটির বিকল্প ব্যবহারের প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
জানা যায়, ভৈরবের পুরাতন মেঘনা ফেরিঘাট এলাকায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে ২০ কোটি ৭৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা ব্যয়ে ‘স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ভবন’ নামে তিনতলা বিশিষ্ট মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রটি নির্মাণ করে। ২০১৮ সালে নির্মাণকাজ শুরু করে ভবন নির্মাণ শেষ হয় ২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর। ওই মাসেই আনুষ্ঠানিকভাবে ভবনটির উদ্বোধনও করা হয়।
অবতরণ কেন্দ্রটি ২৭ শতাংশ ভূমির উপর নির্মিত হয়েছে। ভবনের চতুর্দিকে সীমানা প্রাচীর, অকশন শেড, প্যাকিং শেড, ৩৫টি আড়ত ঘর, একটি আইসপ্লান্ট, সোলার প্যানেল, কোয়ালিটি কন্ট্রোলার, গভীর নলক‚প, আইস ক্রাসার ও জেনারেটর ব্যবস্থাসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। অবতরণ কেন্দ্রে এক জন ব্যবস্থাপক, এক জন ল্যাব কন্ট্রোলার ও এক জন নাইট গার্ড কর্মরত আছেন।
এত সুযোগ-সুবিধা থাকতেও মৎস্য অবতরণকেন্দ্র নির্মাণের প্রায় দুই বছর অতিবাহিত হলেও এটির কার্যক্রম চালু করা যাচ্ছে না।
কেন্দ্রটি চালু করতে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের নিয়ে দফায় দফায় মতবিনিময় করেও সফলতা অর্জন করতে পারছেন না।
এ বিষয়ে মৎস্য ব্যবসায়ী আহম্মদ মিয়া, মোবারক হোসেন ও হানিফ মিয়া জানান, অবতরণকেন্দ্রটির পাশে ভৈরবের ঐতিহ্যবাহী ‘নৈশকালীন মৎস্য আড়ত’। এখানে প্রায় দুই শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। সিলেট-সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন হাওর উপজেলা থেকে বেপারিরা মাছ নিয়ে এই আড়তে বিক্রি করতে আসেন।
হাওরের মিঠা পানির এসব মাছের দেশব্যাপী ব্যাপক চাহিদা ও কদর থাকায় প্রতিদিন আট থেকে ১০ কেটি টাকার মাছ বিক্রি হয়ে থাকে। এখানে বেপারি, ব্যবসায়ী, কর্মচারী ও শ্রমিক মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।
এই আড়ৎটি সুপরিচিত এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় দূর-দূরান্তের ক্রেতা-বিক্রেতারা সহজেই কেনা-বেঁচার জন্য আসা-যাওয়া করে থাকেন। এ ছাড়া এখানকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো মৎস্য ব্যবসায়ীদের নিজস্ব হওয়ায় ভাড়া গুনতে হয় না। প্রতিটি ঘর তাদের ব্যবসার সুবিধার জন্য বড়সড়ো করে তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি ঘরের সামনে মাছ প্যাকেজিং করার জন্য রাখা হয়েছে পর্যাপ্ত স্থান।
অপরদিকে অবতরণ কেন্দ্রটির অকশন ও প্যাকেজিং শেডগুলো খুব ছোট। যা এখানকার আড়ৎদারদের জন্য খুবই অপ্রতুল। এ ছাড়া মাসিক শেড ভাড়া ও শতকরা তিন টাকা হারে কমিশন দিয়ে তাদের ব্যবসায় লাভ হবে না। বর্তমান স্থানে ঘর ভাড়া ও কমিশন দিতে হয় না। তাই লভ্যাংশের পুরোটাই নিজেদের থাকে।
তবে তাদের অভিমত, অবতরণ কেন্দ্রটি নির্মাণের আগে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে নিলে এই বিপর্যয়ের মধ্য পড়তে হতো না কর্তৃপক্ষকে। বর্তমান আড়তের জমিতে ভবনটি নির্মাণ করে যার যার পজিশন মতো বরাদ্দ দিয়ে দিলেই সেটি সফল হতো।
এ বিষয়ে ভৈরব নৈশকালীন মৎস্য আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজি জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘অবতরণ কেন্দ্রটি চালু করার জন্য আমরা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কয়েক দফায় মতবিনিময় করেছি। আমিসহ আমাদের অনেক ব্যবসায়ী সেখানে শেড ভাড়াও নিয়েছেন। কিন্তু সেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা কেউই যেতে ইচ্ছুক না হওয়ায় লোকসানের মুখে আবার ছেড়ে দিতে হয়েছে।’
হাজি জয়নাল আবেদীন আরও বলেন, ‘বর্তমানে প্রতিযোগিতার এই বাজার যুগে যেখানে শতকরা দুই টাকা মুনাফায় আমরা মাছ বিক্রি করি, সেখানে সরকারকে শতকরা তিন টাকা কমিশন দিয়ে কেন অবতরণ কেন্দ্রে যাব? তাই ব্যবসায়ীরা সেখানে যেতে অনীহা দেখাচ্ছেন।’
এ বিষয়ে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মো. ছিদ্দিকুর রহমান জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় নির্মাণ করা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রটি চালু করতে অনেক মতবিনিময় করা হয়েছে। সবশেষ গত ২ মে একটি সভা করা হয়। সভায় ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে মাসিক ৫০০ টাকা হারে শেড ভাড়া আর শতকরা ৩০ পয়সা হারে কমিশন পূনর্নির্ধারণ করা হয়।
সিদ্ধান্ত হয় নৈশকালীন মৎস্য আড়ত ও সকালের পংকু মিয়া রেলওয়ে মৎস্য আড়তের কিছু ব্যবসায়ী এখানে এসে ব্যবসা শুরু করবেন। ৮ মে থেকে কার্যক্রম শুরু করার কথা থাকলেও তাঁরা কেউ আসেননি। তাই অসুবিধা দেখা দিয়েছে।
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের অচলাবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান সবুজ জানান, হাওরাঞ্চলের সংগৃহীত মাছের একটা বড় অংশ ভৈরবে আসে। এখানে দুটি প্রতিষ্ঠিত মাছের আড়ৎ আছে। সেসব দিক বিবেচনায় নিয়ে সরকার এখানে এই মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রটি নির্মাণ করে। মূলত বিচ্ছিন্ন মাছ ব্যবসায়ীদের একত্রে একই স্থানে জড়ো করতেই এই উদ্যোগ। কিন্তু সুপ্রতিষ্ঠিত দুটি বাজার রেখে নতুন এই জায়গায় ব্যবসায়ীরা আসতে চাইছেন না। ফলে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রটি চালু করা যাচ্ছে না। তাই ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে বিকল্প ব্যবহারের প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।