ঘরে এখনও কাঁদা মাঠি, রেল লাইনে বসতি

Looks like you've blocked notifications!
সাতকানিয়ার কেওচিয়া ইউনিয়নের তেমুহনী এলাকায় দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনে তাবু টানিয়ে দিনাতিপাত করছে বৃদ্ধ সিরাজ মিয়ার পরিবার।

দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক বন্যায় বেশ ক্ষতি হয়েছে কৃষি খাতের। হাজার হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করা নানা প্রজাতির সবজি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতির শিকার চাষিরা। অপর দিকে বাড়ি-ঘর থেকে বন্যার পানি নেমে গেলেও তা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বসতঘর নতুন করে বসবাসের উপযোগী করার জন্য প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে লোকজন।

এদিকে গতকাল শনিবার সাতকানিয়ার কেওচিয়া ইউনিয়নের একাধিক গ্রাম সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায়, বাড়ি-ঘর থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে। লোকজন ঘরে ফিরে তা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বসতঘর নতুন করে বসবাসের উপযোগী করার জন্য প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে লোকজন। তাদেরই একজন তেমুহনী এলাকার সিরাজ মিয়া (৭৫)। বাধ্য হয়ে নির্মিতব্য রেললাইনে তাবু টানিয়ে পরিবারের লোকজন নিয়ে অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

সিরাজ মিয়া বলেন, ‘সাতকানিয়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয় গত সোমবার রাত থেকে। কিন্তু আমাদের গ্রামে পানি উঠে যায় শুক্রবারে। শুক্রবার সাঁতরিয়ে জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে গেছি। মসিজদ থেকে ঘরে ফিরেই আর বের হতে পারিনি। পানিবন্দি হয়ে পড়ি। পরববর্তী দিনগুলো কেটেছে অনেক করুণভাবে। ঘরের চালের উপরে দিন-রাত কাটিয়েছি। আমার জীবনেও এই ধরনের পানি আর দেখিনি। এখন পানি কমে গেছে। ঘরে গিয়ে দেখি ঘরের ভেতরে কমোর সমান কাঁদা মাঠি জমে আছে। এই মাঠি না সরাতে পারলে ওই ঘরে বসবাস করার সুযোগ নেই। তাই বাধ্য হয়ে রেললাইনে তাবু টানিয়ে  পরিবারের নারী-শিশুদের নিয়ে দিন কাটাচ্ছি।’

এদিকে বিভিন্ন এনজিও থেকে টাকা ঋণ নিয়ে চাষাবাদ চালিয়ে যাওয়া লোকজন পড়েছে বেশ বিপাকে। যেখানে ক্ষেত থেকে উৎপাদিত সবজি বিক্রয় করে ঋণের টাকা শোধ ও পরিবারের খরচ নির্বাহ করার কথা ছিল, সেখানে পুরো ক্ষেত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চোখে অনেকটা অন্ধকার দেখছে তারা।

বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের সবজিক্ষেত পরিদর্শন ও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

জানা যায়, চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী পৌরসভার লালটিয়ার চরটি সবজিক্ষেতের জন্য বিখ্যাত। লালটিয়ার চরে উৎপাদিত সবজি সারা দেশে সরবরাহ করে থাকে ব্যবসায়ীরা। এবারের ভয়াবহ বন্যায় পুরো লালটিয়ার চরের সবজিক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষেত মাড়িয়ে পলি মাঠিতে ভরে গেছে জমি। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে চলছে হাহাকার।

দোহাজারীর লালটিয়ার চর এলাকায় বন্যার পানিতে নষ্ট হয়ে যাওয়া সবজিক্ষেত দেখাচ্ছেন চাষি জয়নাল আবেদীন।

কৃষক জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘আমার করলা তরু, কইডা ও মূলা মিলিয়ে প্রায় আটকানি (প্রায় সাড়ে তিন একর) সবজিক্ষেত ছিল। শঙ্খ নদের প্রবল স্রোতের কারণে সব সবজিক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। জমিতে কোমর সমান পড়েছে পলিমাঠি। অন্তত এক মাসেও ওই জমিতে আর চাষাবাদ করা যাবে না। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে আমার।’

শুধু জয়নাল আবেদীন নন, মিজানুর রহমান, মোহাম্মদ হারুন, মীর আহমদ, মোহাম্মদ সোহেলের সবজিক্ষেতেরও একই অবস্থা। সবার ক্ষেতই নষ্ট হয়ে গেছে। লোহাগাড়ার পুটিবিলা ইউনিয়নের হাসনা ভিলা এলাকায় সানমুন অ্যাগ্রোর বিশাল সবজিক্ষেত তদারকিতে আছেন বাজালিয়ার বড়দোয়ারা এলাকার বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ। তিনি জানান, তাদের অ্যাগ্রো প্রজেক্টে ১০ একর জায়গায় বেগুনক্ষেত, এক একরে করলা ও এক একরে লাউ সবজি রয়েছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে প্রায় নয় একর জমির সবজি। এ ছাড়া একই প্রজেক্টের অধীনে থাকা সাতকানিয়ার ছদাহা এলাকায় প্রায় দুই একর জমির করলা ও বেগুন, পুরানগড় ইউনিয়নের বৈতরণী এলাকায় প্রায় তিন একর বিভিন্ন প্রজাতির সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। এ খাতে সানমুন অ্যাগ্রোর ক্ষতি আনুমানিক ২৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া এ তিন উপজেলার বিস্তীর্ণ জমির সবজিক্ষেত নষ্ট হয়ে যায়।

লালটিয়ার চরের চাষি মোহাম্মদ সোহেল বলেন, ‘আমরা অনেকেই এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করি। এখন আমাদের চাষ করা সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আমরা কিস্তি কীভাবে পরিশোধ করব, ভেবে কুল পাচ্ছি না।’

লোহাগাড়ার পদুয়া ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন জানান, লোহাগাড়ার পদুয়াসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে কৃষি খাতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সাতকানিয়ার ছদাহা ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আইয়ুব জানান, ছদাহা ইউনিয়নে ব্যাপক সবজি চাষ হতো। বন্যার পানির কারণে বেশিরভাগ সবজিক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। গেছে। নতুন করে চাষিদের আবার ঘুরে দাঁড়ানো অনেক কঠিন।

কেওচিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ওসমান আলী বলেন, ‘আমার ইউনিয়নটি বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। অনেকের ঘর ভেঙে গেছে। তারা অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের জন্য ব্যাপক আকারে গৃহ নির্মাণ সামগ্রী দরকার।’

সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন বিশ্বাস বলেন, ‘এখন আমরা ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছি। বিভিন্ন দপ্তর ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন তৈরি করছে। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাওয়া গেলে কোন খাতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা জানাতে পারব। তবে সাতকানিয়ায় দুই হাজার ১৬২.৫ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ ৩২ কোটি ২৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অনুরূপভাবে লোহাগাড়া ও চন্দনাইশেও কৃষি খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে।