খুলনায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের জমি জটিলতায় ঘর হস্তান্তরে বিলম্ব!
প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ ও হস্তান্তরে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে তুঘলকি কাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে। নিষ্কণ্টক খাস জমিতে ঘর নির্মাণের নির্দেশনা থাকলেও কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে স্থানীয় প্রশাসন ব্যক্তিনামের জমি জোরপূর্বক দখল করে প্রধানন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর করেছে। জমির মালিকানা নিয়ে জটিলতা দেখা দেওয়ায় এসব ঘর হস্তান্তর করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রশ্ন উঠেছে, ব্যক্তি মালিকানার জমিতে সরকারি ঘর তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে। উপজেলা প্রশাসন অনিয়মের কথা স্বীকার করলেও শুধু নায়েবকে বদলি করে বিষয়টি ধামাচাপা দিয়েছে।
ভুক্তভোগী ও স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের শুরু থেকে ২০২২ সালের মার্চে এ উপজেলায় মোট ১০০৫টি ঘর নির্মাণ করে ডুমুরিয়া উপজেলা প্রশাসন। খাস জমিতে এসব ঘর নির্মাণের নির্দেশনা থাকলেও কুলবাড়িয়া বরাতিয়া মৌজার হঠাৎপাড়া রাজবাড়ী এলাকায় ব্যক্তির নামে রেকর্ডকৃত জমিতে ৩০টির অধিক ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। অন্যান্য আরও কিছু ঘরের জায়গা নিয়েও জটিলতা রয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরীফ আসিফ রহমান চলতি বছরের মার্চ মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে ঘর হস্তান্তরের কথা জানালেও এখনও বন্দোবস্ত সম্পন্ন হয়নি। ঘর নির্মাণের সময় বাধা আসতে পারে এমন আশঙ্কায় পুলিশ পাহারা রেখেছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
আলমগীর হোসেন ও রিজিয়া বেগমসহ জমির বর্তমান মালিকরা জানান, নব্বইয়ের দশকে আয়েজ শেখ, খোকন দাস, আহম্মদ মোড়লসহ অনেকের নামে খাস জমি বন্দোবস্ত দেয় সরকার। পরবর্তীতে বরাদ্দ পাওয়া এসব জমি নিজ নিজ নামে আরএস রেকর্ডভুক্ত হয়। তারা উপজেলার কুলবারিয়া বরাতিয়া মৌজার ২৬০৫, ২৬০৬, ২৬০৭, ২৬২০, ২৬১৬, ২৫২০ খতিয়ানভুক্ত জমির রেকর্ডীয় মালিকানা পান। দীর্ঘদিন ধরে এসব জমিতে বসবাসসহ চাষাবাদ করেছেন। পরবর্তীতে এসব জমির মালিকরা ৭২৭/২০০৩, ৪২০৬/২০১৯, ৮২৬/২০১৯, ৩৪৫০/২০১১, ৭৩৫৪/২০১৭, ১৯৭৭/২০০৬, ৭২৯/২০০৩, ৭২৮/২০০৩, ৪২৪৭/২০০৬ ও ৬২৬৩/২০০৫ নম্বর দলিলে ছকিনা বেগম, জেসমিন বেগম, দেলোয়ার হোসেন, আফিরন বেগম, কুদ্দুস গাজী, নুর আলী, সিরাজুল, হবিবর, রশিদ, হালিম, করিম, আলমগীর হোসেন ও রিজিয়া বেগমের নামে জমি হস্তান্তর করেন। এভাবে দলিলমূলে অনেক জমির মালিকানা পরিবর্তন হয়ে গেছে। এ কারণে বরাদ্দ পাওয়া অনেকে এখন আর ওই জমির মালিক নন।
তবে বিপত্তি ঘটেছে আরেক ঘটনায়। এসব ঘর বরাদ্দ পাওয়া আয়েজ শেখ, খোকন দাস, আহম্মদ মোড়লসহ অনেকের জমির মালিকানা না থাকলেও তাদের কাছ থেকে ওই জমি নতুন করে লিখে নিয়েছেন ইউএনও। জমির মালিকানা হস্তান্তরের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর জমির দলিলমূলে বর্তমান মালিকদেরকেও ওই জমি লিখে দেওয়ার জন্য ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। একই মৌজার অন্য একটা অংশের বন্দোবস্ত গ্রহীতা আব্দুল হান্নান ও সুবলের জায়গাতেও জোরপূর্বক দখল করে ১৬টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানা যায়। নদী শ্রেণী বিলীন করে ২০১৩-১৪ সালে বন্দোবস্ত দিয়ে তাদেরকে এ জমির দখল দিয়েছিল সরকার।
ভুক্তভোগীরা জানান, গত মার্চে ইউএনওর নির্দেশে সহকারী কমিশনার (ভূমি) আফরোজ শাহীন খসরু প্রশাসনের নামে জমি রেজিস্ট্রি করে দিতে চাপ দেন। এভাবে ঘর নির্মাণ করায় এবং বারংবার আবেদন করে প্রতিকার না পাওয়ায় কাঁঠালতলা গ্রামের শ্যামল কুমার দাস হাইকোর্টে মামলা করেছেন। অন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প আরজি সাজিয়ারা, চিংড়ায় নির্মিত কিছু ঘরেও মালিকানা সংক্রান্ত সমস্যা আছে। আরও জানা যায়, জমির জটিলতায় শতাধিক ঘরের বন্দোবস্ত দিতে পারছে না উপজেলা প্রশাসন। কাগজপত্রে ত্রুটি থাকার কথা উল্লেখ করে তা সংশোধনের নাম করে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা ও সার্ভেয়ারের মাধ্যমে কৌশলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই টাকার বিনিময়ে সাফ কবলা দলিল ও দানপত্র দলিলের মাধ্যমে কিছু জমি ইতোমধ্যে লিখে নিয়েছে ইউএনও। এখন চেষ্টা করছেন বন্দোবস্ত দেওয়ার।
এদিকে, ব্যক্তি জায়গায় ঘর নির্মাণই শুধু না, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। সঠিক পরিমাণ নির্মাণ সামগ্রী না দিয়ে দায়সারাভাবে কাজ শেষ করা হয়েছে। ঘর তৈরির জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের অধিকাংশই আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব ঘর উদ্বোধনের আগেই তা ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
কুলবাড়িয়া বরাতিয়া ইটভাটা সংলগ্ন আবাসনের নদীর তীরে বস্তির মতো ২২টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। একই মৌজার কিছু জায়গায় পরিকল্পনা বহির্ভূতভাবে মুখোমুখি ঘর না করে সেফটি ট্যাংক সামনে রেখে আরেক লাইন ঘর করা হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া কয়েকজন বাসিন্দা জানান, সেফটি ট্যাংকের দুর্গন্ধে এখানে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এসব জমি সরকারের নামে লিখে দিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরীফ আসিফ রহমান প্রতিনিয়ত চাপ দিচ্ছেন। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিনিয়ত হুমকি-ধমকি ও ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। এ বিষয়ে একাধিক অভিযোগ জানানো হলেও কোনো তদন্ত বা সুরাহা করা হয়নি। ভুক্তভোগীদের দাবি সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ ছাড়া এ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব নয়।
এ ব্যাপারে, প্রকল্পের সদস্য সচিব উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. আশরাফ হোসেন জানান, জমির জটিলতায় বেশ কিছু ঘর নির্মাণ এখনও সম্পন্ন করা যায়নি। জমি নিয়ে জটিলতা কেন এমন প্রশ্ন করা হলে পিআইও বলেন, জমির বিষয়ে ইউএনও স্যার (উপজেলা নির্বাহী অফিসার) ভালো বলতে পারবেন।
ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শরীফ আসিফ রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘খাস জমিতে কৃষিকাজ করার কথা থাকলেও বাস্তবে জমির মালিকরা সেটা বিক্রি ও ইট ভাটা করেছে। আমরা সেটা উচ্ছেদ করেছি। অনেকে বন্দোবস্তকৃত জমির কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। যার কারণে আমরা খাস করে প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করেছি। যারা জমির দলিল এখনও পায়নি তারা পেয়ে যাবে। এটা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে কাউকেই জোর করে জমি লিখে দিতে বাধ্য করা হয়নি। তাছাড়া স্থানীয় কিছু লোক সরকারের এই কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য নানান ধরনের অপপ্রচার ছড়াচ্ছে।’
বিষয়টি ভুল হয়েছে স্বীকার করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘লিজ দেওয়া জমি ফাঁকা থাকায় আশ্রয়ণের ঘর করা হয়েছিল। পরে জানতে পেরে সেখানে ঘর করা বন্ধ রাখা হয়েছে। ভূমি অফিসের ভুলে বেশিরভাগ নদীর জায়গা বেদখল হয়েছে। এসব জমি উদ্ধারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
জমির মালিকানা নিয়ে শ্যামল কুমার দাসের উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা স্বীকার করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সাংবাদিকরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর ডুমুরিয়া উপজেলা ভূমি অফিসের নায়েবকে তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়েছে।’
খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফিন এনটিভি অনলাইনকে ভুল স্বীকার করে বলেন, ‘কিছু ভুল হয়েছে সেটা সংশোধন করে নেওয়া হবে। ডুমুরিয়া এক সময় ছিল নদী প্রধান এলাকা। কিন্তু উজানে পানি প্রবাহ না থাকায় বেশিরভাগ নদী ভরাট হয়ে গেছে। আর সেই জমি প্রভাবশালীরা দখলে নিয়েছে।’
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ‘অনেকের জমির বন্দোবস্ত বাতিল করা হয়েছে। বাতিল বন্দোবস্তকৃত জমিতে প্রকল্প নিতেই পারি। তবে যদি কারও কাছ থেকে জোর করে জমি রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার মতো অভিযোগ পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব।’