ঢাকা-কক্সবাজার রুটে বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল শুরু আজ
পর্যটন নগরী কক্সবাজার ও রাজধানী ঢাকার মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল আজ শুক্রবার (১ ডিসেম্বর) থেকে শুরু হচ্ছে। আজ দুপুর সাড়ে ১২টায় কক্সবাজার থেকে যাত্রী নিয়ে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকার পথে যাত্রা করবে স্বপ্নের ট্রেন। এজন্য পূর্বাঞ্চলীয় রেলবিভাগের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
কক্সবাজারের সঙ্গে ট্রেন যোগাযোগ চালুর লক্ষ্যে কক্সবাজার শহরের ঝিলংজায় ঝিনুকের আদলে তৈরি করা হয়েছে এশিয়ার সর্ববৃহৎ আইকনিক রেল স্টেশন। আজ থেকে হাজারো যাত্রীর পদভারে মুখরিত হয়ে উঠবে দৃষ্টিনন্দন এই স্টেশন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১১ নভেম্বর কক্সবাজারে নবনির্মিত আইকনিক স্টেশনে এই রেলপথ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পর ট্রেনের সময়সূচি নির্ধারণসহ প্রয়োজনীয় সব কাজ শেষ করেছে রেল বিভাগ।
এই পথে ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ায় পর্যটকসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ ও উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। কক্সবাজারে পর্যটন শিল্পের জন্য তৈরি হয়েছে নতুন সম্ভাবনা। বিপুল সংখ্যক পর্যটক কক্সবাজার ভ্রমণে আসতে ইতোমধ্যে হোটেল বুকিং দিয়েছে। আগামী ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই রুটে ট্রেনের সব টিকিট অগ্রিম বিক্রি হয়ে গেছে।
কক্সবাজার আইকনিক রেল স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্টেশন মাস্টার গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচলের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আমরা এখন সেই কাঙ্ক্ষিত সময়ের অপেক্ষায় রয়েছি। শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টায় কক্সবাজার স্টেশন থেকে ৭৮০ জন যাত্রী নিয়ে প্রথম ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। অপরদিকে, রাত সাড়ে ১০টায় সমসংখ্যক যাত্রী নিয়ে ঢাকা থেকে আরেকটি ট্রেন কক্সবাজারের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে।’
স্টেশন মাস্টার গোলাম রাব্বানী জানান, এই রুটে আপাতত দুটি ট্রেন চলাচল করবে। কক্সবাজার থেকে ট্রেন ছাড়বে দুপুর সাড়ে ১২টায়। চট্টগ্রাম হয়ে এটি ঢাকায় পৌঁছাবে রাত ৯টা ১০ মিনিটে। অন্যদিকে, ঢাকা থেকে ট্রেন ছাড়বে রাত সাড়ে ১০টায়। এটি কক্সবাজার পৌঁছাবে পরদিন সকাল ৭টা ২০ মিনিটে।
গোলাম রাব্বানী আরও জানান, ট্রেনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এসি চেয়ার আসন ৩৩০টি এবং নন এসি শোভন শ্রেণিতে আসন সংখ্যা ৪৫০। চট্টগ্রামের যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত থাকবে দুটি কোচ। এই রুটে এসি স্নিগ্ধা শ্রেণি ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার ৩২৫ টাকা। নন এসি শোভন শ্রেণির ভাড়া ৬৯৫ টাকা। কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের ভাড়া এসি ৪৭০ টাকা এবং নন এসি ২৫০ টাকা।
মনোমুগ্ধকর আইকনিক রেল স্টেশন
কক্সবাজার শহরের ঝিলংজায় ঝিনুকের আদলে তৈরি আইকনিক রেল স্টেশন এখন দর্শনার্থীদের জন্য অন্যতম আকর্ষনীয় স্থাপনায় পরিণত হয়েছে। পর্যটকসহ হাজার হাজার লোক প্রতিদিন এই স্টেশনটি দেখার জন্য ভিড় করছেন। কক্সবাজার শহর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর নির্মিত এই স্টেশন ভবনটির আয়তন এক লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয় তলা এই ভবনে রয়েছে নানান সুযোগ সুবিধা।
রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘আমাদের সবার জন্য গর্বের বিষয় কক্সবাজার আইকনিক রেল স্টেশন ভবন। এ রকম অনন্য স্থাপনা অন্য কোথাও নেই। এটি এশিয়ার প্রথম শতভাগ পর্যটনবান্ধব কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছয়তলা স্টেশন। ঝিনুকের আদলে তৈরি স্টেশনে আবাসিক হোটেলের পাশাপাশি ক্যান্টিন, লকার, গাড়ি পার্কিং ইত্যাদি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পর্যটকরা স্টেশনের লকারে লাগেজ রেখে সারাদিন সমুদ্র সৈকতে বা দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে পারবেন। স্টেশনে রয়েছে মসজিদ, শিশু যত্নকেন্দ্র ও চলন্ত সিঁড়ি। এখানে রয়েছে এটিএম বুথ, পোস্ট অফিস, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুথসহ নানা সেবা কেন্দ্র।’
রেলমন্ত্রী বলেন, ‘২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত আইকনিক এই স্টেশনটি নির্মাণে চীন, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। পুরো প্রকল্পটিতে ১১০ জন বিদেশি সহ মোট ২৫০ জন প্রকৌশলী এবং ছয় শতাধিক লোক কাজ করেছে। চার বছরের শ্রমে অনন্য সুন্দর রেলস্টেশন ভবনটির কাজ শেষ হয়েছে।’
বদলে যাবে কক্সবাজার
কক্সবাজার হোটেল মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম বলেন, ‘ট্রেনে চড়ে হাজারো পর্যটক কক্সবাজার ভ্রমণে আসছে। স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। ট্রেন যোগাযোগের কারণে বদলে যাবে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প। অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে, এটা অনেক আনন্দের।’
আবুল কাসেম বলেন, ‘ট্রেনে চড়ে প্রথম দিনে যেসব যাত্রী কক্সবাজার আসবে, স্টেশনে তাদেরকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানাবে হোটেল মোটেল গেস্ট হাউজ মালিক সমিতি। রেল যোগাযোগ চালু হওয়ায় পর্যটকদের জন্য কক্সবাজারের সব হোটেল মোটেলে বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।’
কক্সবাজার পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান বলেন, ‘স্বপ্নের রেল এখন পর্যটন শহর কক্সবাজারে। এই রেলপথ বাংলাদেশের উন্নয়নে যুগান্তকারী ঘটনা। ব্রিটিশ, পাকিস্তানের সুদীর্ঘ সময় ও স্বাধীন বাংলাদেশের অর্ধশত বছরে যা হয়নি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার তা করে দেখালেন।’
আয়াছুর রহমান বলেন, ‘এই রেলপথ কক্সবাজারকে আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে পরিপূর্ণতা দেবে। বিদেশি পর্যটক আনতে সহায়ক হবে। শুধু শীতকালে নয়, বর্ষাসহ সারা মৌসুম পর্যটকরা কক্সবাজার ভ্রমণে উৎসাহিত হবে।’
কক্সবাজার শিল্প ও বাণিজ্য সমিতির পরিচালক মোস্তাক আহমদ বলেন, ‘সহজ রেল যোগাযোগের কারণে কক্সবাজার এলাকায় উৎপাদিত পণ্য মাছ, শুঁটকি, লবণ, পান, সবজিসহ নানান পণ্য পরিবহণ ও বিদেশে রপ্তানির সুযোগ বাড়বে। কক্সবাজারসহ দেশের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসবে।’
কক্সবাজার-রামু আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরোয়ার কমল বলেন, ‘রেল যোগাযোগ চালু হওয়ায় কক্সবাজারে পর্যটকদের উপস্থিতি বৃদ্ধির পাশাপাশি স্বল্প সময়ে ও কম খরচে কৃষিপণ্য, মাছ, লবণ পরিবহণ করা যাবে। এতে কক্সবাজারের পর্যটনসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।’
সাইমুম সরোয়ার কমল বলেন, ‘এই রেলপথ মিয়ানমার, চীনসহ এই অঞ্চলের সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ তৈরি করবে। আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। কক্সবাজার এলাকায় ব্যাপক হারে বিনিয়োগ হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।’
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জিএম মো. নাজমুল ইসলাম জানান, কক্সবাজারে ট্রেন চলাচল ইতোমধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। সব টিকিট অনলাইনে অগ্রিম বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিবছর প্রায় ৬০ লাখ পর্যটক কক্সবাজারে আসেন। তাদের বেশির ভাগই যাতায়াত করেন বাসে। অনেকে বিমানে যাতায়াত করেন। এখন বেশির ভাগ পর্যটক ট্রেনে ভ্রমণ পছন্দ করছেন।’
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার ট্রেন পথ
কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীন জানান, ২০১৮ সালের জুলাইয়ে দোহাজারি থেকে কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণে মেগা প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এই মেগা প্রকল্পে দোহাজারি থেকে কক্সবাজার ১০২ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার ট্রেনপথ ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে দোহাজরি পর্যন্ত ৪৮ কিলোমিটার পথ ব্রিটিশ আমলে তৈরি। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি হাতে নেয় বর্তমান সরকার। এটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার বিবেচনায় গৃহীত একটি মেগা প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় সংস্কার করা হয়েছে শতবর্ষী কালুরঘাট সেতু।