মিডিয়া কাভারেজ পেতেই বিএনপির রেললাইনে নাশকতা : জিএমপি
দেশ ও বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি ও ব্যাপক মিডিয়া কাভারেজ পেতেই ঢাকা-ময়মনসিংহ রেললাইনে নাশকতার ঘটনা বলে জানিয়েছে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ। এ ঘটনায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরসহ সাত বিএনপির নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আজ রোববার (১৭ ডিসেম্বর) বেলা ১টায় গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি) সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন পুলিশ কমিশনার মাহবুব আলম।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার প্রহলাদপুর ইউনিয়নের বনখড়িয়া এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ রেললাইনে এ নাশকতার ঘটনা ঘটে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন গাজীপুর জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম, পুলিশ সুপার কাজী শফিকুল আলম, জেলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমানসহ রেলওয়ে কর্মকর্তা, জেলা ও মহানগর পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা।
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন জান্নাতুল ইসলাম (২৩), রফিকুল ইসলাম, মেহেদী হাসান (২৫), মো. হাসান আজমল ভুঁইয়া (৫০), জুলকার নাইন আশরাফি ওরফে হৃদয় (৩৫), শাহানুর আলম (৫৩), মো. সাইদুল ইসলাম (৩২) ও সোহেল রানা (৩৮)।
জিএমপি কমিশনার বলেন, “একটি নাশকতার মামলা তদন্ত করতে গিয়ে আমরা জানতে পারি যে, একদল দুষ্কৃতকারী গত ১৩ ডিসেম্বর ভোর আনুমানিক ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার প্রহলাদপুর ইউনিয়নের বনখড়িয়া এলাকায় চিলাই রেল ব্রিজের পাশে রেললাইন কেটে ফেলে। এর ফলে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস’ ট্রেনটির ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এ দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই আসলাম নামে একজন নিহত হয়। আর ১০ থেকে ১২ জন আহত হয়।”
পুলিশ কমিশনার জানান, ঘটনার পর পরই মেট্রোপলিটন পুলিশ তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষণ করে। এর ভিত্তিতে গতকাল শনিবার দুষ্কৃতকারীদলের সদস্য জান্নাতুল ইসলামকে (২৩) আটক করে। তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ট্রেনে নাশকতার ঘটনা ঘটানোর উদ্দেশে তারা ১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কোনাবাড়ী এলাকা থেকে একটি হায়েস গাড়ি (মাইক্রোবাস) ঢাকা যাওয়ার কথা বলে ভাড়া করে। কিন্তু গাড়ির আরোহী সবাই মুখোশ পরে ঢাকায় না গিয়ে গাজীপুরেই বিভিন্ন স্থানে ঘোরাফেরা করতে থাকে। এ অবস্থায় ড্রাইভার ভয় পেয়ে, তাদের ঢাকায় না যাওয়ার কারণ এবং মুখোশ পরার কারণ জিজ্ঞেস করলে তাদের মধ্যে একজন মুখোশ খুলে। এ সময় ড্রাইভার তাকে চিনতে পারলেও কিছু বলতে সাহস পায়নি। পরে তারা ওই মাইক্রোবাস নিয়ে রেললাইন কেটে নাশকতা ঘটানোর উদ্দেশে বের হয়। শহরের শিববাড়ীর জোড় পুকুরপাড় এলাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে বেশ কয়েকজনকে গাড়িতে উঠায়। পরে তারা গাজীপুর শহরের জোড় পুকুরপাড়ের ইবনে সিনহা তোহার বাড়ি থেকে রেললাইন কাটার জন্য যন্ত্রপাতি, দক্ষিণ সালনার উসমান গনির ভাড়া দেওয়া ‘বাঁশ বাগান’ রেস্টুরেন্ট থেকে দুটি গ্যাস সিলিন্ডার গাড়িতে উঠায়। তারা এসব সরঞ্জাম নিয়ে রাত ১০টায় শিমুলতলী এলাকায় একটি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খায়। রাতের খাবার শেষে ১১টায় হোটেল থেকে বের হয়ে ফের গাড়ি নিয়ে শহরের ভিতরে বিভিন্ন অলিগলিতে ঘোরাঘুরি করে। রাত দেড়টার দিকে তারা ঘটনাস্থল শ্রীপুরের বনখড়িয়া এলাকায় চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে বনের পাশে গাড়ি রেখে হেঁটে গ্যাস সিলিন্ডারসহ সরঞ্জামাদি নিয়ে বনখড়িয়া চিনাই রেল ব্রিজের পাশে যায়। রাত ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে রেললাইনের ২০ ফুট গ্যাস কাটার দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এর কিছু সময় পর ওই রেলপথে নেত্রকোনা থেকে ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ভোর ৪টা ১৫ মিনিটের দিকে দুর্ঘটনার শিকার হয়।
পুলিশ কমিশনার আরও জানান, এ ঘটনা ঘটিয়েই তারা গাড়ি নিয়ে ঢাকায় চলে যায়। ঢাকায় গিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে চারজন গাড়ি থেকে নেমে যায় এবং বাকি সদস্যরা মিরপুরে গিয়ে নামে। মিরপুরে নেমে তারা নিজেদের কাছে টাকা না থাকায় ফোনে অন্য একজনকে ড্রাইভারের বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠাতে বলে। সেই মোতাবেক জনৈক ব্যক্তি ড্রাইভার সাইফুলের বিকাশে আট হাজার ১০০ টাকা পাঠায়। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিবি (উত্তর) বিভাগের একাধিক টিম গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গাতে অভিযান চালিয়ে ট্রেনে নাশকতার সঙ্গে জড়িত জান্নাতুল ইসলাম (২৩) এবং মেহেদী হাসানকে (২৫) আটক করে।
পুলিশ কমিশনার আরও জানান, তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থদাতা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২৮ নং ওয়ার্ডের কাউন্সির মো. হাসান আজমল ভুঁইয়া। ওই নাশকতার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নকারী সদস্যরা সবাই বিএনপি ও বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতা এবং সক্রিয় সদস্য।
পুলিশ কমিশনার দাবি করেন, ১১ ডিসেম্বর রাতে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সাবেক বিএনপিনেতা আজমল বুঁইয়ার বাসাসহ বিভিন্ন স্থানে সভা হয়। ওই সভায় রেললাইন কেটে নাশকতার পরিকল্পনা করা হয়। ওই সভায় আলোচনা হয়, দলীয় উচ্চ পর্যায় থেকে বড় কিছু করার চাপ আছে, বড় কোনো ঘটনা ঘটলে দেশ ও বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হবে। তাই তারা রেললাইনে নাশকতার পরিকল্পনা করে। সরকারের বর্তমান নির্বাচনি কার্যক্রমকে বিতর্কিত করা, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমানে বিরাজমান রাষ্ট্রীয় সুশৃঙ্খল পরিবেশকে নষ্ট করা, জনমনে ভীতি সঞ্চার করা এবং এর মাধ্যমে দেশ ও বিদেশে ব্যাপক মিডিয়া কাভারেজ, হরতাল-অবরোধ সফল করার জন্য ব্যাপক প্রাণহানির ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য রেললাইনকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। যা দেশ ও বিদেশে আলোড়ন তৈরি করতে পারে। তার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৩ ডিসেম্বর ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে নাশকতার ঘটনা ঘটানো হয়। এই ঘটনায় ব্যবহৃত মাইক্রোবাসটি জব্দ করা হয়েছে।
মাইক্রোবাসের চালক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে এবং নাশকতার কাজে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার ও অন্যান্য জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছে।