ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট জানিয়েছে, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর নির্দেশনায় গাজীপুরের শ্রীপুরে রেললাইন কাটে ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি ও বর্তমান যুবদলনেতা মো. ইখতিয়ার রহমান কবির। আজ সোমবার (২৫ ডিসেম্বর) ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান এ তথ্য জানান। 

রেললাইন কেটে নাশকতা ঘটানোর মূলহোতা কবিরসহ (৪৩) দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে সিটিটিসি ইউনিট।

সিটিটিসির দেওয়া তথ্য অনুসারে জানা গেছে, রেললাইনে নাশকতা সৃষ্টি করে সাধারণ জনগণের মাঝে ভীতি সঞ্চার ও ব্যাপক প্রাণনাশের পরিকল্পনা করেন যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু। দলীয় উচ্চপর্যায় থেকে বড় কিছু করার চাপ থেকে গ্রেপ্তার যুবদলনেতা ইখতিয়ার রহমান কবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি।  নাশকতাকারীদের রেললাইন কাটার পর তাদের দলীয় পর্যায় থেকে মোটা অংকের টাকাও দেওয়া হয় বলে উল্লেখ করেন মো. আসাদুজ্জামান।

রেলে নাশকতার পরিকল্পনার বিষয়ে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘রাজধানীতে গাড়ি ভাঙচুর, আগুন দেওয়া ও বোমা বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক ছিল। সাধারণ মানুষ রেলকে নিরাপদ বাহন হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল। কিন্তু ট্রেনে চলাচল করা মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়াতে ও রেল চলাচল বিঘ্ন করতে নাশকতার পরিকল্পনা করা হয়। পাশাপাশি নাশকতার মাধ্যমে রেলে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটনোর উদ্দেশ্য ছিল। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যুবদলের শীর্ষনেতা সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর নির্দেশে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসভাপতি ইখতিয়ার রহমান কবিরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কবির গাজীপুর ছাত্রদলের দুই নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা হলেন—গাজীপুরের আজিমুদ্দিন সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সাবেক আহ্বায়ক তোহা, গাজীপুর মহানগর ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুম। তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়।’

মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ওই নেতাদের বলা হয়, স্থান নির্বাচন করে নাশকতা সফল করার জন্য। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য তোহা ও মাসুম মিলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসান আজমল ভূঁইয়ার বাসায় একটি বৈঠক করে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কৌশল ঠিক করে। প্রথমে তাদের সিদ্ধান্ত ছিল রেললাইনের নাট-বল্টু খুলে ট্রেন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা। কিন্তু তারা নাট-বল্টু খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর বিষয়টি কবিরকে জানানো হয়। পরে কবির রেল লাইন কাটার নির্দেশ দেয়। পাশপাশি রেল কাটার জন্য লোকবল দেওয়ার কথা জানায়। এ জন্য তিনি লালবাগ থানার ২৪ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি ইমন হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রথমে ইমনকে বড় লোহার পাত কাটা শেখার জন্য টাকা দেওয়া হয়। ইমন লোহা কাটার প্রশিক্ষণ নেন। এরপর স্থানীয়ভাবে গ্যাস সিলিন্ডার কেনা হয়। আর লোহা কাটার জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য যন্ত্রপাতি ঢাকা থেকে কেনা হয়। কবির, ইমন, তোহা ও মাসুম মিলে রাজধানীর পুরান ঢাকার নবাবপুর মার্টেকের একটি দোকান থেকে ১০ ডিসেম্বর সব যন্ত্রপাতি কিনে ইমনের বাসায় রাখে।’

মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১২ ডিসেম্বর ইমনের বাসা থেকে যন্ত্রপাতি গাজীপুর নিয়ে যাওয়া হয়। একই দিন ইমন ও কবির কমলাপুর থেকে ট্রেনে করে জয়দেবপুর রেল স্টেশনে যায়। এরপর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তোহা ও মাসুম চলাচলের জন্য মাইক্রোবাস ভাড়া করা, গ্যাস সিলিন্ডার কেনাসহ সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। এই সময়ে তারা ট্রেনের শিডিউল জেনে রাখে। এরপর ১৩ তারিখ রাতে স্থানীয় একটি রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খাওয়ার পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে রওনা দেয়। এই সময়ে বেশ কয়েকজনকে পথ থেকে তুলে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে ঘটনাস্থলে মোট নয়জন একত্রিত হয়ে রেললাইন কাটার কাজ শুরু করে। আগে থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া ইমন অন্যদের সহযোগিতায় রেললাইন কাটে। এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী কবির পরিকল্পনা করা এবং বাস্তবায়নের সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।’ 

ডিএমপির এ কর্মকর্তা বলেন, ‘পরবর্তীতে ঘটনাস্থলে দুটি গ্যাস সিলিন্ডার ফেলে যায়। অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে তারা ঢাকায় চলে আসে। ভাড়া করা মাইক্রোবাস তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের গেটে নামিয়ে দেয়। পরবর্তীতে রেল লাইন কাটার যন্ত্রপাতি ইমনের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। এই সময়ে কবির বেশ কিছু টাকা দেয় ইমনকে। এরপর রেললাইন কাটায় ব্যবহৃত মালামাল রেখে তারা আত্মগোপনে চলে যায়। রেললাইন কাটা সফল হয়েছে বলে কবির নির্দেশদাতা টুকুকে জানিয়ে দেয়। পরবর্তীতে কবিরকেও বড় অংকের টাকা পাঠায় নির্দেশদাতা।’

ছবি : ডিএমপি

সিটিটিসির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘গ্রেপ্তার কবির এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, গত ২৮ অক্টোবর থেকে যাত্রাবাড়ি, ডেমরা, নিউ মার্কেট, পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ১০টিরও বেশি বাসে আগুন দিয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই নির্দেশদাতা রেললাইন কাটার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া নাশকতার বেশ কয়েকটি ঘটনায় তার নাম এসেছে। এর আগে পুরান ঢাকার বংশাল এলাকায় গান পাউডারসহ ছাত্রদলকর্মী গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদেও কবিরের নাম এসেছে। বিশেষ করে মহানগর দক্ষিণ এলাকায় যত নাশকতা ঘটেছে তার বেশিরভাগ ঘটনার মূল পরিকল্পনা ও নির্দেশদাতা হিসেবে তিনি জড়িত বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। ডেমরায় বাসে আগুনের ঘটনায় চালকের সহকারী নিহতের ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে তাকে আমরা খুঁজছিলাম। সবকয়টি ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কবিরকে আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানানো হবে।’

বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের কোনো নেতার নির্দেশনা ছিল কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে কেউ হতে পারে। নির্দেশদাতাদের মধ্যে যুবদলের সভাপতি সালাউদ্দিন টুকু আছেন। টুকু কবিরকে ডেকে জানায়, ওপর থেকে রেলে নাশকতার নির্দেশ আছে। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে কবিরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।’