ঘুষের টাকা ফেরত পেতে লাশ হয়ে বিদ্যালয়ে এলেন শিক্ষিকা

Looks like you've blocked notifications!
সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার গাড়াবেড় বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় চত্বরে ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষিকা রোকেয়া খাতুনের মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স। ছবি : এনটিভি

ঘুষের টাকা ফেরতের দাবিতে রোকেয়া খাতুন নামে এক শিক্ষিকার মরদেহ নিয়ে বিদ্যালয়ে অবস্থান নেন তাঁর স্বজনরা। আজ সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) এ ঘটনা ঘটেছে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার চালিতাডাঙ্গা ইউনিয়নের গোদাগাড়ি চকপাড়া, গাড়াবেড় বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে  (জিসিজি)।

খবর পেয়ে স্থানীয়রা বিদ্যালয়ে জড়ো হলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি দ্বীন মোহাম্মদ বাবলু ও প্রধান শিক্ষক ফরিদুল ইসলাম গিয়ে উত্তেজিত জনতার সামনে আগামী তিন দিনের মধ্যে ওই ঘুষের টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে শিক্ষিকার মরদেহ নিয়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করেন স্বজনরা।

টাকার শোকে গত ৩০ জানুয়ারি শিক্ষিকা রোকেয়া খাতুন বাবার বাড়িতে স্ট্রোক করেন বলে দাবি স্বজনদের। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ ভোররাতে রাজধানী ঢাকার একটি হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।

শিক্ষিকা রোকেয়া খাতুন জিসিজি উচ্চবিদ্যালয়ের মাধ্যমিক শাখার ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষিকা ছিলেন। ২০ বছর ধরে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেও বেতন পাননি তিনি। বরং বেতন পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাসে দফায় দফায় টাকা নিয়েছেন ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি।

বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষিকার স্বজনরা জানান, রোকেয়া খাতুনের স্বামীর বাড়ি বগুড়া জেলার ধুনট উপজেলার ভূতবাড়ি গ্রামে। কাজীপুর উপজেলার গাড়াবেড় গ্রামে তাঁর বাবার বাড়ি। বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে নিয়মিত পাঠদান করিয়েছেন তিনি। কিন্তু বেতন পাননি। বেতন পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন সময় ঘুষ নিয়েছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দ্বীন মোহাম্মদ বাবলু।

বিদ্যালয়ের অফিস সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে জিসিজি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হয়। পরে ২০০৪ সালের ৩ আগস্ট বিভিন্ন পত্রিকায় ইংরেজি শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। একই বছরের ২৩ অক্টোবর নিয়োগ পরীক্ষার পর ৬ নভেম্বর বিদ্যালয়টিতে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন রোকেয়া খাতুন। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত থেকে নিয়মিত পাঠদান করেও বেতন পাননি তিনি।

স্বজনরা জানায়, রোকেয়া খাতুনকে বেতন করে দেওয়ার কথা বলে দফায় দফায় চার লাখ টাকার মতো নেন প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি। টাকা নিয়েও তাঁরা বেতন করে দেননি। এ নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে টেনশনে দিন কাটছিল রোকেয়ার। এমতাবস্থায় টাকার শোকে গত ৩০ জানুয়ারি স্ট্রোক করেন তিনি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ তাঁর মৃত্যু হলে মরদেহ নিয়ে বিদ্যালয়ে চলে আসেন তাঁর স্বজনরা। এ সময় তাঁরা ঘুষের সেই টাকা ফেরতের দাবি জানান। খবরটি এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয়রা বিদ্যালয়ে ছুটে আসে। এ সময় তারা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। পরে প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি চার লাখ টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে মরদেহ নিয়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করেন স্বজনরা।

রোকেয়া খাতুনের স্বামী আব্দুল করিম বলেন, ‘আমি নিজেও বিদ্যালয়টিতে শিক্ষক হিসেবে ঢুকেছিলাম। তখন বিদ্যালয়ের ঘর করার কথা বলে আমার স্ত্রী ও আমার কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকা নেন প্রধান শিক্ষক ফরিদুল। এরপর আমি সেখান থেকে সরে এলেও আমার স্ত্রী থেকে যায়। বেতন করে দেওয়ার কথা বলে পরে দফায় দফায় চার লাখ টাকা নেয় তারা। কিন্তু বেতন করে দেয়নি। এই টেনশনে আমার স্ত্রী স্ট্রোক করে মৃত্যু মারা গেছে। আমি ওই টাকা ফেরত চাই। সেই সঙ্গে এই দীর্ঘদিন যে পরিশ্রম করেছে তার ক্ষতিপূরণ চাই।’

রোকেয়ার বড় ভাই খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমার বোনকে বেতন করে দেওয়ার কথা বলে প্রধান শিক্ষক ফরিদুল ইসলাম, সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দ্বীন মোহাম্মদ বাবলু পর্যায়ক্রমে সাত থেকে আট লাখ টাকা নিয়েছে, কিন্তু বেতন করে দেয়নি। একদিকে টাকার শোক অন্যদিকে বেতন না হওয়ায় আমার বোন স্ট্রোক করে মারা গেছে। আমরা এর ন্যায়বিচার চাই।’

বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক ফরিদুল ইসলাম টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘বেতন করে দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন সময় রোকেয়ার কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে। রোকেয়ার টাকা দিয়েই আমরা বিদ্যালয়ের ঘর ওঠাই।  আগামী ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমরা তাঁর চার লাখ টাকা ফেরত দেব।’

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও কাজীপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দ্বীন মোহাম্মদ বাবলু বলেন, বেতন করে দেওয়ার কথা বলে রোকেয়ার কাছ থেকে আমরা যে টাকা নিয়েছি তার চার লাখ টাকা রোকেয়ার স্বজনদের ফেরত দেব।’

এ বিষয়ে কাজীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহরাব হোসেন বলেন, ‘ঘটনাটি দুঃখজনক। শিক্ষিকার মরদেহ নিয়ে বিদ্যালয়ে অবস্থানের খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে যাই। প্রধান শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের সভাপতির সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। আগামী তিন দিনের মধ্যে তাঁরা চার লাখ টাকা ফেরত দেবেন।’