মৃত্যুর প্রায় দুই বছর পর নাশকতার মামলার আসামি বিএনপিনেতা
এ যেন রূপকথা কিংবা পৌরাণিক গল্পকেও হার মানানো কাহিনি! মৃত্যুর এক বছর ৭ মাস ১১ দিন পর সাভারে কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে বাস পুড়িয়েছেন তিনি! শুধু বাস পোড়ানোই নয়, সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশে দেশে ভীতিকর পরিবেশ তৈরির জন্য মামলার বাদীসহ চালক ও হেলপারকে বাস থেকে নামিয়ে দেন বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।
যার বিরিুদ্ধে এ মামলা তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (জাকসু) সাবেক সাধারণ সম্পাদক (জিএস), পাথালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানা বিএনপির প্রয়াত সভাপতি আজগর হোসেন। এ মামলায় তাঁর সহযোগী আরও ৫২ জনকে আসামি করা হয়েছে। যাঁদের বেশিরভাগই বিএনপি-জামায়াতের পদধারী নেতাকর্মী। সাভার মডেল থানায় এ মামলাটি করা হয়। মামলা নম্বর-৫৬।
প্রায় পৌনে দু্ই বছর আগে মৃত এ বিএনপিনেতা কীবাবে এ অপরাধ করলেন এমন প্রশ্ন করতেই মামলার বাদী আলমগীর হোসেন ভাষায় বলেন, ‘আমার বাড়ি রাজশাহী, থাকি নাটোরে। সাভারে যারা আমাদের মারধর করে বাস পুড়িয়ে দিয়েছে আমি তাঁদের কাউকে চিনি না। কোনদিন দেখিওনি। আমার মালিক বলল, সাভার থানায় যেতে, আমি গেলাম। আর পুলিশ একটা টাইপকরা কাগজ দিয়ে বলল সই দিতে, আমি সই দিলাম। এর বাইরে আমি আর কিছু জানি না।’
কোন বাছ বিছার না করেই এভাবে মামলা করায় প্রশ্ন উঠেছে মামলার প্রক্রিয়া নিয়ে। আইনজীবীরা বলেছেন, এভাবে পাইকারীভাবে যত্রযত্র যাকে তাকে আসামি করায় তদন্তের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। শেষ বিচারে এমন প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রম সুবিচারের পথকে রুদ্ধ করবে। মাঝে কিছু মানুষ সীমাহীন হয়রানির কবলে পড়ে নিঃস্ব হবে।
বেঁচে থাকতেই অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে কোট-কাচারীতে দৌড়াদৌড়ি করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (জাকসু) সাবেক সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ও ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানা বিএনপির প্রয়াত সভাপতি আজগর হোসেনের স্ত্রী সোহেলি সুলতানা।
স্বামীকে নিয়ে এমন হয়রারির একপর্যায়ে গা সহার মতো হলেও মৃত্যুর এত দিন পরও আসামি হবেন তা তাঁর যে কল্পনাতীত।
সোহেলি সুলতানা বলেন, ‘কিন্তু সেটাই দেখলাম! বুঝলাম মরেও শান্তি নেই! আমার স্বামী আশুলিয়া থানা বিএনপির সভাপতি ও পাথালিয়া ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০২২ সালের ১১ ডিসেম্বর রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন তিনি। স্বজনদের পরামর্শে সাভার ও আশুলিয়া থানায় তাঁর মৃত্যু সনদও দেওয়া হয়েছিল। যাতে আমরা একটি স্বস্তিতে থাকতে পারি। মৃত মানুষকে নিয়ে আর টানাটানি না করে। কিন্তু মৃত্যুর পৌনে দুই বছর পরে এসে প্রায় সব কটি রাজনৈতিক মামলায় শ্বশুড়ের নামটি ঠিক রেখে ভুল ঠিকানা ও ভুল নামে আমার স্বামীকে আসামি করা হচ্ছে। জানি না কার কাছে আক্ষেপ করব! সত্যিই দুঃখজনক।’
কেবল যে মৃত বিএনপিনেতা মামলার আসামী হয়েছেন তা নয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতার ঘটনায় পাইকারি হারে আসামি হয়েছেন অনেকেই। সাভার থানায় করা মামলায় সাধারণ মানুষের পারিবারিক জীবনকে বিষিয়ে তুলছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসী।
সাভার পৌর ছাত্রদলের সাবেক নেতা ও সাভার সিটি সেন্টারের দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ওবায়দুর রহমান অভিকে বিভিন্ন মামলার আসামি করা হয়েছে। ঘটনার আগে থেকেই তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন রাজধানীর একটি হাসপাতালে। পরিবারের অভিযোগ, তার বাড়িতে হামলা চালিয়ে লণ্ডভণ্ড করে দেওয়া হয়েছে।
সাভার পৌরসভার ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর ও পৌর মহিলা দলের সভাপতি ডারফিন আক্তার ও তাঁর ছেলে সজিবকেও করা হয়েছে নাশকতার বিভিন্ন মামলার আসামি। মামলার এজাহারে কাউন্সিলর ডারফিন আক্তারের পরিবর্তে লেখা হয়েছে ডরফিন কমিশনার। আর তাঁর ছেলে সজিবের বাবার নাম উল্লেখ করা হয়েছে ডরফিন কমিশনার। অথচ কাউন্সিলর ডারফিন আক্তার সজিবের মা। আর সজিবের বাবার নাম শরীফ।
একইভাবে মামলায় আসামি করা হয়েছে সাভার পৌর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক, পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুর রহমানকেও। অথচ তিনি ঘটনার কয়েক দিন আগে থেকে তিনি চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে অবস্থান করছিলেন।
আবদুর রহমানের স্ত্রী দিলরুবা আক্তার রুমি বলেন, ‘আমার স্বামী চিকিৎসার জন্য গত ১৬ জুলাই থাইল্যান্ডে গেছেন। চিকিৎসা শেষ না হওয়ায় তিনি দেশে ফেরেননি। এরপরও আমার স্বামীকে ১৮ জুলাইয়ের বাস পোড়ানোর ঘটনাসহ কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংস ঘটনায় দায়ের করা একাধিক মামলায় আসামি করা হয়েছে। আমার বাসাতে হামলা চালিয়ে তছনছ করা হয়েছে। কোনো প্রতিকার পেলাম না। এসব কারণে প্রকৃত আসামিরা আড়ালেই থেকে যাবে—যোগ করেন দিলরুবা আক্তার রুমি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শাহ্ জামান বলেন, ‘প্রিন্টিং মিস্টেক বা তথ্যে ভুলের কারণে এমন হতে পারে। তবে তদন্ত করে ভুল শুধরিয়েই আদালতে যথাযথ প্রতিবেদন দেওয়া হবে।’