অবশেষে মাথায় গুলিবিদ্ধ ছেলের লাশ খুঁজে পেলেন বাবা
ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ। চারিদিকে লাশের গন্ধ। আশপাশে অন্তত ২০ জন মানুষ। অধিকাংশের মুখে মাস্ক। হঠাৎ চোখ পড়ল, একজন বয়স্ক ব্যক্তি কাঁদছেন। কী হয়েছে জানতে চাওয়ায় ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলের লাশ নিতে এসেছি। উত্তরাতে আন্দোলন করছিল। পুলিশ মাথায় গুলি করে মেরে ফেলছে।’
ছাত্র-জনতার আন্দোলন তখন তুঙ্গে। চারিদিকে রক্তের গন্ধ। এমন এক সময় গত ৪ আগস্ট বিকেলে উত্তরার হাউস বিল্ডিংয়ের বাসা থেকে বের হন ৩০ বছর বয়সী আনারুল ইসলাম। তারপর থেকে তিনি নিখোঁজ। আনারুলের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলায়। ফুলপুর থেকে শুরু করে রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতালসহ নানা স্থানে খোঁজ করেও পাওয়া যায়নি তাকে। শেষ পর্যন্ত ১১ দিন পর তার বাবা রফিকুল ইসলাম আজ বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) পান মরদেহ। যার মাথায় লেগেছিল গুলি।
গতকাল বুধবার ফুলপুর থানা থেকে রফিকুলকে দেওয়া হয়েছিল ছেলে লাশের সন্ধান। জানানো হয়েছিল, আনারুল ইসলামের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে রাখা আছে। এ খবর যখন জানতে পারেন, তখন রফিকুল উত্তরার হাউস বিল্ডিংয়ের বাসায় ছিলেন। বুধবার রাতেই তিনি ঢামেক মর্গে আসেন। সারারাত সেখানেই ছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে মর্গের ফ্রিজ খুলে ছেলের লাশ শনাক্ত করেন। এরপর মর্গ থেকে তাঁকে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে যেতে বলা হয়।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, আনারুলের মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ৪ আগস্ট। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ৮ আগস্ট মারা যান। তারপর ওই হাসপাতাল থেকে ঢামেক মর্গে পাঠানো হয় মরদেহটি। আজ সকালে রফিকুল কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রীতে যান। মরদেহ পেতে আবেদন করেন। তারপর ওই হাসপাতাল থেকে ‘লাশ হস্তান্তর’ সংক্রান্ত একটি চিঠি দেয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ বরাবর।
রফিকুল ইসলাম বলছিলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি করত। ময়মনসিংহ ও রাজধানীর অনেক স্থানে খুঁজে কোথাও পাইনি ছেলেকে। কেঁদেছি আর খুঁজেছি। আমার খাওয়া-ঘুম সব হারাম হয়ে গেছে। ১১ দিন পর অবশেষে পেলাম মাথায় গুলি লাগা ছেলের লাশ। আমি ফ্রিজে ঢুকে লাশ শানাক্ত করি।’
রফিকুল আরও বলেন, ‘বেশ কয়েকদিন ছাত্রদের আন্দোলনে গিয়েছিল আনোয়ার। ছেলেটাকে জীবিত দেখার সৌভাগ্য আমার আর হলো না। আমার আরও তিন মেয়ে রয়েছে। বাড়ির সবাই পাগলের মতো হয়ে গেছে। ছেলের বউ শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
রফিকুল ইসলাম যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন ঢামেকের মর্গে একজন পোশাক পরা পুলিশ ঢোকেন। এ দৃশ্য দেখে রফিকুল ক্ষেপে পুলিশকে গালি দিতে থাকেন। উত্তেজিত হয়ে গালি দিয়ে বলেন, ‘....তোরা আমার ছেলেকে গুলি করে মেরেছিস। আল্লাহ তোদের বিচার করুক।’ এরপর তিনি আবার কেঁদে ওঠেন।’
সর্বশেষে আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টার দিকে আনারুলের মরদেহ বুঝে পান তাঁর পরিবার। ছেলের লাশ বুঝে পাওয়ার আগে রফিকুল এ প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘এখান থেকে ছেলের লাশ নিয়ে সোজা ময়মনসিংহে চলে যাব। গ্রামের বাড়িতে ছেলের লাশ দাফন করব।’
সাড়ে ৩টার দিকে ঢামেক মর্গের সহকারী সেকেন্দার আলী বলেন, ‘ঢামেক মর্গে মোট আটটি অজ্ঞাত লাশ রাখা ছিল। পরিচয় শনাক্ত হওয়ার পর আজ দুটি লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি আর ছয়টি লাশ আছে। আর ঢামেক হাসপাতালের মর্গে আরও ১০টি অজ্ঞাত লাশ রাখা আছে বলে আমি জানি।’