সালমান-আনিসুল হকও স্বাদ নিলেন লোহার খাঁচার
রাজধানীসহ সারাদেশে বিচারিক আদালতে আসামিদের হাজির করার পর লোহার খাঁচায় রাখা হতো। পশু রাখার মতো লোহার খাঁচায় মানুষ রাখা মানবাধিকার লঙ্ঘন, এমন সমালোচনার মধ্যে লোহার খাঁচা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় বর্তমান সরকার। আলোচিত মুখগুলোর মধ্যে সর্বশেষ সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও লোহার খাঁচার স্বাদ নিয়েছেন। এরপর গতকাল শুক্রবার থেকে লোহার খাঁচা সরানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।
আজ শনিবার (১৭ আগস্ট ) খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের দ্বিতীয় তলায় ২৭ ও ২৮ নম্বর ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত কক্ষ থেকে লোহার খাঁচা সরানো হয়েছে। উচ্চপর্যায় থেকে লোহার খাঁচা সরিয়ে ফেলার নির্দেশনা পাওয়ার পর গতকাল শুক্রবার দুপুরের পর থেকে লোহার খাঁচা সরানো হয়। পর্যায়ক্রমে সকল আদালত থেকে এটি সরানো হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু; সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতকে আদালতের লোহার খাঁচায় রাখা হয়নি। অবশ্য গতকাল সিএমএম আদালত কক্ষে লোহার খাঁচা ছিল।
শুক্রবার বিকেলে গিয়ে দেখা গেল, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানকে ঢাকার সিএমএম আদালতে আনা হয়েছে। কিন্তু আদালত কক্ষের ভেতর থাকা লোহার খাঁচা দেখা যায়নি। সিএমএম আদালতের কয়েকজন কর্মচারির সাথে কথা বলে জানা যায়, উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তের পর শুক্রবার থেকে আদালত কক্ষ থেকে লোহার খাঁচা সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। গণপূর্ত বিভাগের লোকজন লোহার খাঁচাগুলো খুলে নিয়ে গেছেন।
এর আগে ঢাকার আদালতগুলোয় কয়েক বছর ধরে গ্রেপ্তারের পর কাউকে আদালতে তোলা হলে এজলাস কক্ষের এক পাশে থাকা একটি লোহার খাঁচায় রাখা হচ্ছিল। আবার কোনো মামলার আসামি হয়ে কেউ হাজিরা দিতে গেলে তাঁকেও খাঁচার মধ্যে ঢুকতে হয়।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলে আসছিলেন, এজলাস কক্ষে এভাবে আসামিকে লোহার খাঁচায় ঢোকানো অমানবিক ও সংবিধান–পরিপন্থি। এই ব্যবস্থা আর থাকা উচিত নয়।
চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি একটি রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট শিশির মনির। রিটের পর সারাদেশের আদালতগুলোতে লোহার খাঁচার তালিকা চেয়ে রুল এখনো শুনানি হয়নি।
অ্যাডভোকেট শিশির মনির এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বিচারের মুখোমুখি কোনো আসামির সঙ্গে সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদের চেতনার পরিপন্থি কোনো আচরণ সমর্থনযোগ্য নয়। একজন আসামিকে লোহার খাঁচায় ঢোকানো কিংবা ঢুকতে বাধ্য করা অমানবিক। এটি সংবিধানের চেতনার পরিপন্থি। বর্তমান সরকার লোহার খাঁচা সরানোর এ সিদ্ধান্ত নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সার্বজনীন মানবাধিকার সকলের জন্য নিশ্চিত হবে এই প্রত্যাশা করি।
সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না কিংবা কারও সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না। এ ছাড়া নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার–সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সনদের (ইন্টারন্যাশনাল কভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস–আইসিসিপিআর) ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কাউকে নির্যাতন বা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি দেওয়া যাবে না।
আইসিসিপিআরের অনুচ্ছেদ ১৪(২) অনুযায়ী, ফৌজদারি অপরাধের জন্য অভিযুক্ত প্রত্যেকের আইন অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগপর্যন্ত নির্দোষ বলে গণ্য হওয়ার অধিকার থাকবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসও আদালতের এই লোহার খাঁচা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছিল। ওই সব মামলায় হাজিরা দিতে তাঁকে বহুবার আদালতে যেতে হয়েছে।
গত ১২ জুন পুরান ঢাকার একটি আদালতে হাজিরা দেওয়ার পর আদালত চত্বরে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘আজকে আমরা অনেকক্ষণ খাঁচার (আসামির কাঠগড়া) মধ্যে ছিলাম। বলা হয়েছিল, আপনি থাকেন। কিন্তু আমরা সারাক্ষণ লোহার খাঁচার মধ্যে ছিলাম। আমি আগেও প্রশ্ন তুলেছি, এটা ন্যায্য হলো কি না? আমি যত দূর জানি, যত দিন আসামি অপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত না হচ্ছে, তত দিন তিনি নিরপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবেন।’
ড. মুহাম্মদ ইউনূস আরও বলেছিলেন, ‘একজন নিরপরাধ নাগরিককে শুনানির সময় লোহার খাঁচায় (আসামির কাঠগড়া) দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, এটা আমার কাছে অত্যন্ত অপমানজনক। এটা গর্হিত কাজ। এটা কারও ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য না হয়। একটা পর্যালোচনা হোক। একটা সভ্য দেশে কেন একজন নাগরিককে শুনানির সময় পশুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, যেখানে তিনি তখনো দোষী সাব্যস্ত হননি।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, অনেক আইনজ্ঞ আছেন, বিচারপক্ষের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা পর্যালোচনা করে দেখবেন, এটা রাখার দরকার আছে কি না। সারা সভ্য দুনিয়ায় যেভাবে হচ্ছে, সেভাবে হবে। আমরা সভ্য দেশের তালিকায় থাকতে পারি। লোহার খাঁচা মানবতার প্রতি অপমান। কেন পশুর মতো একজন মানুষকে খাঁচার ভেতর ভরে রাখবে? এটা সরিয়ে ফেলা উচিত।’