১৫ বছরে গুম-খুনের সিঁড়ি বেয়ে নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক হয়ে ওঠেন শেখ হাসিনা
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ জোট। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে নানা টালবাহানায় বিভিন্ন উপায়ে পার করেন টানা সাড়ে ১৫ বছর। ‘দিনের ভোট রাতে’, ‘মরা ব্যক্তির ভোটে’, ‘ভোট জালিয়াতি’ ও প্রশাসনের সব স্তরকে ব্যবহার করে ‘ভোট ডাকাতি করে’ ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ক্রমেই হয়ে ওঠেন নিষ্ঠুর স্বৈরাচার। ক্ষমতাকে ধরে রাখতে ক্ষমতার অপব্যবহারে কীভাবে হিংস্র হয়ে ওঠেন তিনি, বিরোধীমত দমনে কীভাবে গণহত্যা, গুম, খুন করেছেন তার বিশদ বর্ণনা উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায়।
আজ বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) বেলা সাড়ে ১১টা। চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইমসলাম যখন শেখ হাসিনা ও তাঁর দোসরদের অপরাধের চিত্র তুলে ধরছিলেন তখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ছিল পিনপতন নীরবতা। চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে বর্ণনা হচ্ছিল এসব। শুননির সময় প্রসিকিউটর পক্ষ উপস্থিত থাকলেও আসামিপক্ষের কোনো আইনজীবী ছিলেন না।
এই ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। একপাশে প্রসিকিউটর টিম, অপরপাশে সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকদের প্রবেশ করেন সেখানে।
পরে শুনানি নিয়ে আদালত দুটি পৃথক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গণহত্যার অভিযোগে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা, সাবেক সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে শেখ হাসিনাকে আগামী ১৮ নভেম্বরের মধ্যে গ্রেপ্তার করে ট্রাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশ দেওয়া হয়। আদালতের এ আদেশের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে চলা হত্যাকাণ্ড নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু হলো।
যাদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করা হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন—সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, লেখক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান, শেখ হাসিনার তৎকালীন নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারেক আহমেদ সিদ্দিক প্রমুখ।
ভোটহীন চারটি নির্বাচন
আদালতে বেশ কিছু অভিযোগ তুলে ধরেন প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। তার প্রথম অভিযোগে বলা হয়, ২০০৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা সারাবিশ্বে নজিরবিহীন একতরফা কূটকৌশলে ভোটহীন চারটি নির্বাচন করে ক্ষমতা দখল করে ক্রমে স্বৈরাচার হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে দানবরূপে জাতির সামনে আবির্ভূত হয়।
সেনাবাহিনীকে ধ্বংসে পিলখানা হত্যাকাণ্ড
২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার বিদেশি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে একীভূত হয়ে সারা বিশ্বে সমাদৃত দেশের সেনাবাহিনীকে ধ্বংসের জন্য পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এ হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনা নিজে নেতৃত্ব দিয়ে দলের নেতাদের ব্যবহার করেছেন।
শাপলা চত্বরে ছাত্র-জনতার ওপর ব্রাশফায়ার
২০১৩ সালে ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনে রাতের আঁধারে নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর ব্রাশফায়ার ও পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে। রাষ্ট্রীয় মদতে তাদের হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো বিচার হয়নি। এমনকি হত্যাকাণ্ডের পর লাশ গুম করা হয়।
খুন করে লাশ গুম
গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনা ভিন্ন মত সহ্য করতে পারতেন না। ভিন্ন মতের কেউ হলে খুন করে লাশ গুম করা হতো। আয়নাঘর তৈরি করে সেখানে বছরের পর বছর মানুষকে আটক রাখা হতো। পরিবার লাশের অপেক্ষা করেও কোনো হদিস পেত না। এছাড়া অনেক পরিবার বছরের পর অপেক্ষা শেষে সংসার পেতেছিল।
বাকস্বাধীনতা হরণে কালো আইন
স্বৈরাচার শেখ হাসিনার অপরাধের মাত্রা তুলে ধরে প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, গত ১৫ বছরে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ভিন্নমতের সাংবাদিকদের দমনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে কালো আইন তৈরি করে। এ আইনের কয়েকটি ধারা ব্যবহার করে মানুষের বাকস্বাধীনতাকে হরণ করেন শেখ হাসিনা। বহু বছরে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিকদের কারাগারে নিক্ষেপ, হত্যা, গুম করা হয়।
রাজাকার ট্যাগ
শেখ হাসিনা ও আসামিদের অপরাধের ধরন তুলে ধরে ষষ্ঠ অভিযোগে আদালতকে প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, বিজ্ঞ আদালত, প্রতিপক্ষকে হেনস্তা করতে ‘রাজাকার’ ট্যাগ দিয়ে এটিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।
জুলাই-আগস্টে গণহত্যা
আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর জুলাই-আগস্টে গণহত্যা চালানো হয়। রংপুরে শহীদ আবু সাঈদকে সরাসরি গুলি করে হত্যা করা হয়। যে ভিডিও দেখে সারাবিশ্বের মানুষ কেঁদেছে। যা দেখে সারাবিশ্বের মানুষের বুক কেঁপে ওঠে। হত্যাকাণ্ডের পরিণতি এত ভয়াবহ ছিল মানুষ এখনো আঁতকে ওঠে। এ হত্যাযজ্ঞ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা এতটা নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছে যে, ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে ছাই করে ফেলে।
সামনে দাঁড় করিয়ে বুকে মাথায় গুলি
প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নিষ্ঠুরতার কথা তুলে ধরে আদালতে বলেন, ছাত্র-জনতাকে হত্যার পর এপিসোড গাড়ি থেকে যেভাবে ফেলে দেয় তা বর্ণনা করার মতো নয়। লাশ দুজনে দুই হাত ধরে ছুঁড়ে মারে। এ ছাড়া সামনে দাঁড় করিয়ে বুকে মাথায় গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। জুলাই-আগস্টে দুই হাজার ছাত্র-জনতাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।
প্রভাবশালী আসামিদের গ্রেপ্তার করা না হলে তদন্ত অসম্ভব
পরে প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম আদালতে বলেন, বিজ্ঞ আদালত এই অপরাধগুলো বিস্তৃত মাত্রায় দেশজুড়ে সংঘটিত হয়েছে। এই অপরাধের আসামি যারা, তারা অসম্ভব রকমের প্রভাবশালী। তাদের গ্রেপ্তার করা না হলে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করাটা অসম্ভব। তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ, এমনকি শহীদ পরিবারের সদস্যরাও কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আসামিদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি আবশ্যক।
পলাতক শেখ হাসিনার হুমকি
এ পর্যায়ে আদালত জানতে চান আসামিদের অবস্থান সরকারিভাবে আপনাদের জানা আছে কিনা? জবাবে প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের জানা নেই। শেখ হাসিনা পলাতক রয়েছেন। অজ্ঞাত স্থান থেকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
যে আদেশ দিলেন আদালত
এ পর্যায়ে আদালত দুটি আবেদনের পর গণহত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনা ও অপর মামলায় ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
যেখানে হলো শুনানি
ট্রাইব্যুনালের (পুরাতন) মূল ভবনের সংস্কার কাজ চলমান থাকায় ভবন সংলগ্ন (অস্থায়ী) ট্রাইব্যুনালে আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১১টায় আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মহিতুল হক এনাম চৌধুরী এদিন ট্রাইব্যুনালে আসেন। এ সময় ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার ও অন্য কর্মকর্তারা তাদের অভ্যর্থনা জানান।
যা জানালেন চিফ প্রসিকিউটর
শুনানির পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর সাংবাদিকদের বলেন, আমরা দুটি আবেদন করেছি, একটি আবেদনে শুধু শেখ হাসিনাকে রাখা হয়েছে। অপরটিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং সাবেক মন্ত্রিপরিষদের সদস্যসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন জানানো হয়েছে। সেটিও মঞ্জুর করেছেন ট্রাইব্যুনাল। এই অপরাধীদের অনেকে এখনো রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। সে কারণে তাঁদের সবার নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।