১৫ বছরের গদি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা ৩ মাস ধরে ভারতে
আজ ৫ নভেম্বর। ঠিক তিন মাস আগের এই দিনে কোটি জনতা নেমে এসেছিল রাজপথে। সেদিন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ওঠা কণ্ঠধ্বনিতে কম্পিত হয়েছিল রাজধানীর অলিগলিও। গণঅভ্যুত্থানে গণভবনের বিলাসিতা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন ১৫ বছরের দুঃশাসনে বাংলাদেশকে বিকিয়ে দেওয়া স্বৈরাচার। এরপর মন খুলে কথা বলার স্বাদ নিতে থাকেন দেশের নাগরিক।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন শেখ হাসিনা। নানা আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে মইন ইউ আহমেদ ও ফখরুদ্দিনের কাঁধে ভর করে মসনদে বসেন তিনি। তারপর থেকেই খুলে ফেলেন তার নতুন মুখোশ। শুরু করেন বিরোধীদল ও মতকে দমন। এতে ব্যবহার করেন বিচার বিভাগকে। একইসঙ্গে রাজপথের আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে দিয়ে বল প্রয়োগ, মামলা, হামলা, গুম, হত্যার পথ বেছে নেন তিনি। ২০১৪ সালে বিনা ভোটে গদি টিকিয়ে রাখেন শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালে দিনের ভোট করেন রাতে। প্রশাসনের সব স্তরকে ব্যবহার করে ভোট জালিয়াতি, ভোট ডাকাতি ও মরা ব্যক্তির ভোটে ক্ষমতায় এলেও ২০২৪ সালের নির্বাচন খ্যাতি পায় ‘ডামি নির্বাচন’ নামে। এভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে অবস্থান টিকিয়ে রাখা শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন একগুঁয়েমি, বেপরোয়া, অহঙ্কারী; হয়ে উঠেন হিংস্র ‘ওয়ানম্যান আর্মি’। এই অহঙ্কারের আগুনে পুড়ে অবমূল্যায়িত হন দলীয় জ্যেষ্ঠ নেতারাও।
যদিও ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার বেপরোয়া একগুঁয়েমিতাই তার জন্য হয়ে ওঠে কাল। সাত মাস পূর্তির আগেই পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তিনি। তবে, জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দলীয় কর্মীদের ব্যবহার, বাহিনীকে দিয়ে হত্যা-দমনের মাধ্যমে ক্ষমতা আকড়ে পড়ে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন তিনি, তারপরও হয়নি শেষ রক্ষা!
শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বের এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তার হিংস্রতার বিশদ বর্ণনা উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায়। গত ১৭ অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনের চেষ্টায় ‘গণহত্যার’ দুই অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
মসনদের লক্ষ্যে যেভাবে গড়েছিলেন সিঁড়ি
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতার দেখা পায়নি। ১৯৮১ সালের ১৭ মে প্রবাস থেকে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে মনোযোগী হন ক্ষমতা দখলে। কূটকৌশলী হয়ে ওঠেন কখনও গোপনে, কখনও সরবে। বিভিন্ন দলের সঙ্গে সক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি দলের তৃণমূলে নিজের তাবেদারী নেতাকর্মীদের বাছাই করেন। এরপর স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় এলে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেন দেশে-বাইরে। একপর্যায়ে সফল হন তিনি। বাংলা দেশের জনগণকে নানা প্রতিশ্রুতিতে ভুলিয়ে ও বৈদেশিক শক্তিকে ব্যবহার করে ভোটকেন্দ্র দখল, জাল ভোট ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতার স্বাদ পান শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী হয়ে ভুলে যান তার যত রাজনৈতিক ইশতেহার।
১৯৯৯ সাল থেকে ওই মেয়াদের শেষ দুই বছর বিরোধীদের ওপর দমন-নিপীড়ন করে জনগণ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন শেখ হাসিনা। যেকারণে ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়। ক্ষমতায় আসেন বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার।
পাঁচ বছর ক্ষমতা চালানোর পর ২০০৬ সালে ওয়ান-ইলেভেন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেন। কারাগারে যেতে হয় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দ্বিতীয় মেয়াদে ফের ক্ষমতায় বসেন শেখ হাসিনা। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ক্ষমতা গ্রহণের দুই মাসের মাথায় দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটে।
সেনাবাহিনীকে ধ্বংসে পিলখানা হত্যাকাণ্ড
দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশ আভ্যন্তরীণ সংকটে পড়ে। শেখ হাসিনা সরকারে থেকেই মেধাবী সেনাসদস্যদের হত্যাকাণ্ডে মেতে ওঠেন। তার বিরুদ্ধে করা মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গত ১৭ অক্টোবর সূচনা বক্তব্যে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বিডিআর বিদ্রোহে ৭৪ জনকে হত্যাসহ আওয়ামী লীগের শাসনামলে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’-এর সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন।
বক্তব্যে প্রসিকিউটর বলেন, ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরের মাসে ২৫ ফেব্রুয়ারি দেশে নজীরবিহীন ঘটনা ঘটে। বিদেশি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে একীভূত হয়ে সারা বিশ্বে সমাদৃত দেশের সেনাবাহিনীকে ধ্বংসের জন্য পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এ হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনা নিজে নেতৃত্ব দিয়ে দলের নেতাদের ব্যবহার করেছেন। এ ঘটনায় সেনাবাহিনীর চৌকস ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হয়। পিলখানায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে বিডিআর বাহিনীকে ধ্বংস ও পথে বসানো এবং সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার সুপরিকল্পিত করা হয়।
পিতৃহত্যার প্রতিশোধে ছিলেন মরিয়া
প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপিত সারসংক্ষেপে বলা হয়, শেখ হাসিনা ছিলেন প্রতিশোধ পরায়ন। পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নিতে মরিয়া শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় এসে প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদের জারি করা ইনডেমনিটি অরডিন্যান্স বাতিল করেন। শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার মামলা এবং বিচারিক আদালতে রায় দেওয়া হয়।
২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর-২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। ওইদিন (১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করা হয়। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করেন। তারা হলেন—লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) ও লে. কর্নেল এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার)।
সবশেষ ফাঁসি কার্যকর করা হয় ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদের। দুই দশকেরও বেশি সময় ভারতে পালিয়ে থাকার পর ২০২১ সালের ৭ এপ্রিল দেশে ফেরা মাজেদকে ঢাকার গাবতলী থেকে গ্রেপ্তারের পাঁচ দিন পর ১২ এপ্রিল মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
ভিন্ন মত দমনে করেছিলেন ট্রাইবুনাল
গুম, খুন বাদেও বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন মত দমনে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করেছেন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালের পর ২০০৮-এ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে লক্ষ্য আরও ঘণীভূত হয়। সম্প্রতি সেই তথ্য ফুটে ওঠে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের বর্ণনায়। এক-এগারোর পর ক্ষমতায় এসে এই সরকার ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতার অভিযোগ তুলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলাম দমনের প্রক্রিয়া শুরু করেন।
২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। পরে এই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে একে একে ফাঁসিতে ঝুলানো হয় জামাতের আমীর মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে। আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় দলটির নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। গত বছরের ১৪ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে মারা যান তিনি। তার এই মৃত্যু নিয়েও আছে ‘ক্লিনিক্যালি মার্ডার’-এর অভিযোগ।
এ ছাড়া শুনানি চলাকালে মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াতের আমির গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাঁদের আপিলের নিষ্পত্তি হয়।
জামায়াত দমনে প্রোপাগান্ডা, গণজাগরণ মঞ্চ ব্যবহার
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কয়েকজন যাত্রা শুরু করে গণজাগরণ মঞ্চ। প্রথমে এটি প্রগতিপন্থী ব্লগারের উদ্যোগে শুরু হলেও পরে তা প্রোপাগান্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহার হয়েছে বলে আছে অভিযোগ। অনেকের দাবি—জামায়াতে ইসলামীকে দমনে ব্যবহৃত হয়েছে এই মঞ্চ।
ওই সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে অবস্থান নেন কিছু মানুষ। পরবর্তীতে এর সঙ্গে আরও অনেকে যুক্ত হলে তাদের নিয়ে গঠিত হয় গণজাগরণ মঞ্চ।
দ্রুত সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন, কাদের মোল্লার ফাঁসি হলেও বন্ধ হয়নি ভিন্নমত দমনের প্রক্রিয়া। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ পরিচালনা এবং জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধসহ আরও বেশ কিছু দাবি নিয়ে আন্দোলন এগুতে থাকে।
ইসলামি চেতনা দমন
শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের কাযকলাপ দেশের ৯০ ভাগ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হতে থাকে। ইসলাম বিদ্বেষী কিছু সিদ্ধান্তের কারণে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক একটি সংগঠন, যেটি ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি গঠিত হয়। হেফাজতে ইসলাম রাজধানীর শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পালন এবং ঢাকার মতিঝিলে তাদের দ্বিতীয় সমাবেশের আয়োজন করে।
৫ ও ৬ মে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে এই সংগঠনের কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষে বহু হেফাজতে ইসলামের কর্মী, পুলিশ, বিজিবি সদস্যসহ মোট ৪৭ জন নিহত হয় এবং সাংবাদিকসহ আরও অনেকে আহত হয়। তাদের ওপর ফুটপাতের দোকান ও অন্যান্য বইয়ের সাথে কোরআন শরিফ পোড়ানোরও অভিযোগ আনা হয়।
এদিন ধর্মীয় বইয়ের প্রায় ৮২টি দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তবে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কয়েকজন নেতা অভিযোগ করেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা দেবাশীষের নেতৃত্বে কোরআন শরিফ পোড়ানো হয়।
রিজার্ভ চুরি
বাংলাদেশের ইতিহাসে বড় চুরির ঘটনা ঘটেছিল ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে। সেই রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। এখন পর্যন্ত চুরি যাওয়া এ অর্থের মধ্যে ফেরত আনা গেছে এক কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার। বাকি ছয় কোটি ৬০ লাখ ডলার (টাকার অঙ্কে ৫৬০ কোটি টাকা) আদৌ পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। এমনকি, অর্থ ফেরত দেওয়ার আশ্বাসও মেলেনি।
অজ্ঞাত ব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ সুইফট পেমেন্ট পদ্ধতিতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে হাতিয়ে নিয়েছিল। এই অর্থ ফিলিপাইনের মাকাতি শহরে রিজাল ব্যাংকের শাখায় চারটি অ্যাকাউন্টে যায় এবং সেখান থেকে দ্রুত টাকা উত্তোলন করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক একদিন পরে চুরির তথ্য জানতে পারে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তা গোপন রাখে আরও ২৪ দিন। আর বিষয়টি তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় চুরি যাওয়ার ৩৩তম দিনে।
শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি
ব্যাংক খাতে দেশের অর্থনীতির আরেকটি বড় ক্ষেত্র শেয়ারবাজার। সেই শেয়ারবাজারেও ১৫ বছরের ব্যবধানে বড় দুটি কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। একটি ১৯৯৬ সালের কেলেঙ্কারি, অপরটি ২০১০ সালের কেলেঙ্কারি হিসেবে বহুল আলোচিত। আর এই দুটি কেলেঙ্কারির ঘটনার সময়ই দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার।
শেয়ারবাজারের আলোচিত এই দুই কেলেঙ্কারির পর মহাসাড়ম্বরে সরকারের উদ্যোগে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয়। অভিযুক্ত করা হয় অনেককে। এমনকি, দুই কেলেঙ্কারির ঘটনায় মোট ১৭টি মামলা হয়। এর মধ্যে ’৯৬-এর কেলেঙ্কারির ঘটনায় ১৫টি আর ২০১০ সালের ঘটনায় দুটি মামলা।
১৭টি মামলার মধ্যে সাজা হয়েছে কেবল ’৯৬ সালের চিক টেক্সটাইল মামলায়। আর বিচার চলমান আছে অপর একটি মামলার। বাকি ১৫টি মামলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এসব মামলার বিচারিক কার্যক্রমের ওপর উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আর ট্রাইব্যুনালের আসা ২০১০ সালের কেলেঙ্কারির একমাত্র মামলাটিরও মাঝপথে এসে উচ্চ আদালতের আদেশে বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়।
এর ফলে দেখা যাচ্ছে, শেয়ারবাজারের আলোচিত দুই কেলেঙ্কারির ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সিংহভাগই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।
এক যুগেও উন্মোচন হয়নি সাগর-রুনি হত্যার রহস্য
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি। তাদের একমাত্র ছেলে পাঁচ বছর বয়সী মাহির সরওয়ার মেঘ ওই সময় বাসায় ছিল। সাগর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল মাছরাঙা টিভিতে এবং রুনি এটিএন বাংলায় কর্মরত ছিলেন। হত্যার ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম রোমান শেরেবাংলানগর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। প্রথমে মামলাটি শেরেবাংলানগর থানার মাধ্যমে তদন্ত শুরু হয়।
এরপর এর তদন্তভার ঢাকা মহানগর ডিবিকে দেওয়া হয়। দুই মাসেরও বেশি সময় তদন্ত করে ডিবি রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হয়। পরে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টের নির্দেশে হত্যা মামলার তদন্তভার র্যাবের ওপর ন্যস্ত করা হয়। মামলায় রুনির কথিত বন্ধু তানভীর রহমানসহ মোট আসামি আটজন। প্রতিবেদন দিতে দেরি হওয়ায় এর আগে দুটি আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এর আগে ২০২০ সালের ২ মার্চ আলোচিত এই হত্যা মামলার অগ্রগতি প্রতিবেদন হাইকোর্টে জমা দেয় র্যাব। প্রতিবেদনে বলা হয়, এই হত্যাকাণ্ডে দুজন অপরিচিত পুরুষ জড়িত ছিলেন। সাগর-রুনির ব্যবহৃত কাপড়ের সঙ্গে তাঁদের ডিএনএর মিল পাওয়া গেছে। এক যুগেও এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হয়নি।
বিচার বিভাগ নিজের হাতে রাখতে ছাড় দেননি প্রধান বিচারপতিকেও
সংবিধানের ষোড়ষ সংশোধনী বাতিলের রায় দেওয়ার পর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ২০১৭ সালের নভেম্বর তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে পদ ও দেশ ছাড়তে বাধ্য হন সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নজিরবিহীন এক পরিস্থিতির মধ্যে তার কার্যকাল শেষ হয় মেয়াদের ৮১ দিন আগেই। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের তোপের মুখে ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর তিনি সেখানে থেকেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।
২০১৪ সালে এক তরফা নির্বাচন
বাংলাদেশের ইতিহাসে একতরফা নির্বাচনের যেসব নজির রয়েছে তার মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্যতম। সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি।
অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক বিএনপি এবং তাদের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামী সে নির্বাচন বয়কটের প্রেক্ষাপটে অর্ধেকের বেশি আসনে ভোট গ্রহণের প্রয়োজন হয়নি। জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল। নির্বাচনের দিন ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৪৬টি আসনে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হয়। আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক হিসেবে বর্ণনা করে হয়েছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে রাতের কাণ্ড
বাংলাদেশে ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আশ্বাস দিয়ে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর প্রথমবারের মতো এই নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল, ফলে সে বিবেচনায় ২০১৮ সালের এই জাতীয় নির্বাচনের একটা ভিন্ন দিক ছিল। কিন্তু ভোটের আগের রাতে আওয়ামী লীগ ভোটের বাক্স ভরাট করা হয়। ভোটের দিন কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত করে দলীয় নেতাকর্মীদের দিয়ে কেন্দ্র দখর করে রাখা হয়। এক পর্যায়ে বিএনপি এ ভোট প্রত্যাখান করে।
২০২৪ সালের ডামি নির্বাচন
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তার দু-একটি বাদে প্রায় সবগুলোই ছিল বিতর্কিত। ফলে বারবার প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতা নিয়ে। অথচ, সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ক্ষমতা থাকার পরও বেশিরভাগ কমিশনই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি বা করেনি। পারেনি নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দিতে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করতে গিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়াকেই ফেলে দিয়েছে বিতর্কের মধ্যে। নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংসের অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। এসব ক্ষেত্রে কারণ হিসেবে বহুল আলোচিত বিষয় হলো ক্ষমতা প্রয়োগের চেয়ে আনুগত্য দেখাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ছিল ইসি। ২০২৪ সালে 'ডামি ভোটের' আয়োজন করে শেষ হাসিনা সরকারের দীর্ঘ মেয়াদের শেষ পেরেক ঠোকেন হাবিবুল আউয়াল কমিশন। এই ভোটে ডামি প্রার্থী, ডামি ভোটারসহ বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র দখলের অভিযোগ তোলেন অনেকে। যদিও একতরফা নির্বাচনে যায়নি বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো।
নির্বাচনের আগে সাজা দিয়ে খালেদা জিয়াকে কারাগারে প্রেরণ
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটাবল ট্রাস্ট দুর্নীতির দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হোন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
প্রথমে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় পাঁচ বছরের সাজা দেওয়া হয়। ওদিনই তাকে বন্দি করা হয়। পরে ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
দুই বছরের বেশি সময় কারাবন্দি ছিলেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। পরবর্তীতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকার নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছিল।
ভয়ভীতি, গুম-খুনের রাজনীতি
রাজনৈতিক মহলে একথা প্রচলিত আছে যে, নিজের লক্ষ্য অর্জনে ভয়ভীতি, গুম-খুনের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন শেখ হাসিনা। গুমের আলোচিত কয়েকটির মধ্যে একটি ছিল বিএনপিনেতা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের ঘটনা। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল সিলেট থেকে ঢাকায় ফিরে সন্ধ্যায় ফের বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন তিনি। ওই রাতে হোটেল শেরাটন সমর্থকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বাড়ি ফেরার পথে ঢাকার বনানী ২ নম্বর সড়ক থেকে ব্যক্তিগত গাড়িচালক আনসার আলীসহ রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন ইলিয়াস। গুমের শিকার হন বিএনপির আরেক নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ, কবি ফরহাদ মজহার, মোহাম্মদ শফিক উল্লাহ মোনায়েম, মো. হাসান খান, মোহাম্মদ চৌধুরী আলমসহ আরও অনেকে। এর মধ্যে সালাহউদ্দিন আহমেদের খোঁজ মেলে ভারতে আর ফরহাদ মজহারকে পাওয়া যায় যশোরের নওয়াপাড়ায়।
শেখ হাসিনার সরকার ফ্যাসিবাদ টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সাড়ে ১৫ বছরে হাজারো পরিবারের ওপর রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও আক্রোশে বিপর্যয় নেমে আসে।
বাকস্বাধীনতা হরণে কালো আইন
স্বৈরাচার শেখ হাসিনার অপরাধের মাত্রা তুলে ধরে প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, গত ১৫ বছরে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ভিন্নমতের সাংবাদিকদের দমনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে কালো আইন তৈরি করে। এ আইনের কয়েকটি ধারা ব্যবহার করে মানুষের বাকস্বাধীনতাকে হরণ করেন শেখ হাসিনা। বহু বছরে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিকদের কারাগারে নিক্ষেপ, হত্যা, গুম করা হয়।
রাজাকার ট্যাগ লাগিয়ে উদ্দেশ হাসিল
শেখ হাসিনা ও আসামিদের অপরাধের ধরন তুলে ধরে ষষ্ঠ অভিযোগে আদালতকে প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, প্রতিপক্ষকে হেনস্তা করতে ‘রাজাকার’ ট্যাগ দিয়ে এটিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল শেখ হাসিনা ও তার দোসররা।
ভোটের আগে বিচার বিভাগের মাধ্যমে বিএনপি দমন
বিরোধীদলকে দমনে সারাদেশে মামলা-হামলা পথ বেঁচে নেয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। ২০২৪ সালে নির্বাচনের আগে সারাদেশে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের অন্তত ১৫০০ বেশি নেতাকর্মীকে সাজা দেওয়া হয়।
জুলাই-আগস্টে গণহত্যা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর জুলাই-আগস্টে গণহত্যা চালানো হয়। রংপুরে শহীদ আবু সাঈদকে সরাসরি গুলি করে হত্যা করা হয়। যে ভিডিও দেখে সারাবিশ্বের মানুষ কেঁদেছে। যা দেখে সারাবিশ্বের মানুষের বুক কেঁপে ওঠে। হত্যাকাণ্ডের পরিণতি এত ভয়াবহ ছিল মানুষ এখনো আঁতকে ওঠে। এ হত্যাযজ্ঞ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা এতটা নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছে যে, ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে ছাই করে ফেলে।
সামনে দাঁড় করিয়ে বুকে মাথায় গুলি
প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নিষ্ঠুরতার কথা তুলে ধরে আদালতে বলেন, ছাত্র-জনতাকে হত্যার পর এপিসোড গাড়ি থেকে যেভাবে ফেলে দেয় তা বর্ণনা করার মতো নয়। লাশ দুজনে দুই হাত ধরে ছুড়ে মারে। এ ছাড়া সামনে দাঁড় করিয়ে বুকে মাথায় গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। আন্দোলন কেন্দ্রিক হাজারও ছাত্র-জনতাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।
জনবিচ্ছিন্ন হাসিনা সরকার
দেশের ভেতরে আওয়ামী লীগ একা হয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ শাসনে সবাইকে খেপিয়ে তুলেছিলেন শেখ হাসিনা। তাঁর সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ও অর্থনীতির মন্দা পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। আর রাজনৈতিক দিক থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের বাইরে অন্য সব দল সরকারবিরোধী অবস্থানে চলে যায়। এর ফলে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক দিক থেকেও একা হয়ে পড়েন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনেও সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে ভূরাজনীতিতে শেখ হাসিনার সরকার ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পরপর তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন করেও টিকে থাকে। এই আলোচনা চলছিল অনেক দিন ধরে। সরকার চীনের সঙ্গেও একটা সম্পর্ক রেখে চলছিল। গত জুলাই মাসেই ৭ তারিখ থেকে দুই দিন চীন সফর করেছিলেন শেখ হাসিনা। সর্বশেষ সেই সফরে অবশ্য ভালো ফল হয়নি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল অনেক দিন ধরে। বিভিন্ন সময় শেখ হাসিনাসহ তাঁর নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করেছেন। সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন বেড়ে যায়। তবে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ দেশের মানুষ ও শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলে। এতে একেবারে একা হয়ে পড়েন তিনি ও তার সরকার।
শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার লড়াই, অবশেষে পলায়ন
শেখ হাসিনার পলায়নের ৩৬ দিন আগে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে মাঠে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু শেখ হাসিনার একগুয়েমি, অহঙ্কার আর প্রতিশোধ পরায়ণতা শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি পর্যবেক্ষণ থেকে দূরে রেখেছিল। এমনকি, তিনি ছাত্রছাত্রীদের দমনে তাদের পেছনে লেলিয়ে দেন তার প্রশাসনকে। নামিয়ে দেন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলোকে। কিন্তু তাতে সারা দেশে সংঘাত–সংঘর্ষে শত শত জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এরপরও শক্ত হাতে দমনের কথা বলা হয়।
জানা যায়, পতনের আগের দিন ৪ আগস্ট রোববার সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গণভবনে বসে শেখ হাসিনা তাঁর সরকারের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন মন্ত্রী ও কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা জানিয়েছেন, রোববারও সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। এরপরও পরিস্থিতি তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে তাঁরা ধারণা করেছিলেন। কিন্তু চাপ আরও বাড়তে থাকে। গতকাল সকালেই তাঁরা বুঝতে পারেন, তাঁদের সময় শেষ হয়ে গেছে। এরপর শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ৫ আগস্ট পালিয়ে যান ভারতে। যদিও ক্ষমতা ছেড়ে গেলেও প্রতিশোধের আগুনে তারই পেটোয়া বাহিনী পুলিশের হাতে তখনও জীবন দেন আরও অনেককে।
ভারত ছাড়া আশ্রয় মেলেনি কোথাও
এক সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘ভারতকে যা দিয়েছি সেটি তারা সারা জীবন মনে রাখবে।’ এর আগেপরে তার ভারতপ্রীতি নিয়ে ছিল আলোচনা, সমালোচনা, অভিযোগও। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ ভারতেই আশ্রয় নেওয়ার পর এটি ফের সামনে আসে। পরে জানা যায়, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে অন্তত ২০টি চুক্তি ও ৬৬টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। অন্তবর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দাবি, এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের অধিকাংশতেই উপেক্ষিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বার্থ। এভাবেই তিনি সেখানে থেকে গেছেন। যদিও যুক্তরাজ্যে যেতে চেয়েছিলেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর চাউর হয়। তবে, সেখানের তথ্য বলছে, দেশটি তাঁকে নিতে রাজি হয়নি। পরে দুবাইয়ের নামও আসে তালিকায়। বিভিন্নসূত্রের তথ্য, আরব আমিরাতের এই রাজ্যটিও শেখ হাসিনাকে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।