৪ লাখ টাকার জন্য থেমে গেছে নারী ফুটবলার টিনার সম্ভবনাময় ক্যারিয়ার
মাত্র ৪ লাখ টাকার জন্যে চিকিৎসার অভাবে কৃতী নারী ফুটবলার টিনা বিশ্বাসের (১৬) ক্যারিয়ার আজ থেমে গেছে। দেড় বছর যাবত খেলার মাঠ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে গ্রামীণ পারিবারিক বলয়ে আটকে রেখেছেন দেশের কৃতী এই নারী ফুটবলার। সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়ি জীবনের এমন বাধায় মনোবিষাদে কাটছে তার সময়।
অজপাড়াগাঁয়ের তৃণমূল থেকে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে প্রিমিয়ার লীগ খেলা নারী ফুটবলার টিনা বিশ্বাসের (১৬) হাঁটুর লিগামেন্ট ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়ে দেড় বছর যাবত মাঠের বাইরে দুঃসহ কষ্টের জীবন যাপন করছেন। মাঠে ফিরতে না পারায় মানসিকভাবে হয়ে পড়েছেন হতাশাগ্রস্ত।
কিশোরগঞ্জের ভৈরবের রামশংকরপুর গ্রামের মেয়ে টিনা বিশ্বাস। তাঁর বাবা দিনমজুর দীনেশ বিশ্বাস। মা গৃহিণী শুভা রানী বিশ্বাস। পাঁচশ টাকায় দিনমজুরি খাটেন, তাও সপ্তাহের সবদিন থাকে না। তাই ঘরের কোণে কোণে কেবলি অভাব, দারিদ্র্য।
টিনা জানান, এই অভাবের মাঝেও ফুটবলের প্রতি নেশা আর মনের প্রবল ইচ্ছাশক্তিকে পুঁজি করে স্থানীয় আন্তঃবিদ্যালয়, উপজেলা, জেলা পর্যায়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে নিজেকে তুলে ধরেন ফুটবল বোদ্ধাদের কাছে। ডাক পান নিজ জেলা কিশোরগঞ্জের ফুটবল একাডেমিতে কোচিং করতে।
সেখানে কোচিং শেষে নিজের জেলার হয়ে আন্তঃবিভাগ টুর্নামেন্টে জাতীয় পর্যায়ে তিনি নিজেকে মেলে ধরেন। ডাক পান সিলেটের এমকে গ্যালাকটিকো ফুটবল ক্লাবে। পরে তিনি কুমিল্লা ইউনিয়ন ফুটবল ক্লাব ও ঢাকা রেঙ্গাস ফুটবল ক্লাবের হয়ে প্রিমিয়ার লীগে খেলতে থাকেন।
২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর ঢাকা রেঙ্গাস ফুটবল ক্লাবের হয়ে খেলার সময় হাঁটুতে ব্যথা পান। হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়। ক্লাব ও পরিবারের আর্থিক সহায়তায় এক লাখ টাকায় তখন তাঁর সফল অপারেশন হয়।
পরে চিকিৎসকদের পরামর্শে তিনি খেলার মাঠের বাইরে থেকে বিভিন্ন ব্যায়াম করেন। তখন চিকিৎসকরা শুধু ব্যায়ামের কথা বললেও তাঁকে সুইমিং, সাইকেলিং ইত্যাদি করতে বলা হয়নি। আর তাঁর এসবের সুযোগ না থাকায় তিনি করতেও পারেননি।
অপারেশনের ৬ মাস পর সুস্থ হলে আবারও খেলার মাঠে ফেরেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ এক খেলোয়াড় বলে শর্ট না দিয়ে তাঁর হাঁটুতে শর্ট দিলে তাঁর হাঁটুর লিগামেন্ট আবারও ছিঁড়ে যায়।
এই দুর্ঘটনার পর প্রায় দেড় বছর কেটে গেলেও তাঁর ক্লাব ও সহকর্মীরা কেউ আর খোঁজ নিচ্ছেন না। এদিকে চিকিৎসকরা বলছেন, এই অপারেশন করতে তাঁর খরচ হবে ৪ লাখ টাকার মতো। যা দরিদ্র দিনমজুর বাবার পক্ষে সংগ্রহ করা কোনোভাবেই সম্ভব না।
তাই টাকার অভাবে অপারেশন না করতে পেরে গ্রামের বাড়িতে যন্ত্রণাময় দিন যাপন করছেন। যে দুটি পা বল নিয়ে দুরন্ত ছুটে চলতো। সকল বাধা উপেক্ষা করে ভেদ করতো প্রতিপক্ষের কঠিন প্রতিরোধ। জালে জড়াতো বল। সেই পা দুটি আজ স্তব্ধ। যে চোখে ছিল নিজেকে বহু উচ্চতায় নিয়ে যাবার স্বপ্ন, আজ সে চোখে শুধুই হতাশা।
১৬ বছরের এই কিশোরী প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, আমাকে আপনারা সুস্থ করে আর একবার মাঠে নামার সুযোগ করে দেন। আমি আপনাদের হতাশ করবো না। আমি আমার দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য নিজেকে উজার করে দেবো।
তাঁর অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় ৪ লাখ টাকার সহায়তা দিতে দেশবাসী ও সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে টিনা বলেন, আপনারা আমার পাশে না দাঁড়ালে আমার দরিদ্র বাবার পক্ষে কোনোভাবেই এই টাকা যোগাড় করা সম্ভব না। আমিও আর খেলার জন্য মাঠে নামতে পারবো না।
টিনা বিশ্বাসের মা শুভা বিশ্বাস জানান, ছোটবেলা থেকে ফুটবলের প্রতি মেয়ের আগ্রহ দেখে এতো অভাবের মাঝেও মেয়েকে নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছুটে গেছেন। মেয়ের প্রতিভায় তিনি মুগ্ধ হয়ে স্বপ্ন দেখতেন এক সময় এই মেয়ের হাত ধরেই সংসারের অভাব দূর হবে। কিন্তু মেয়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়ে আজ ঘরে বসা।
অপারেশনের এতো টাকা তাদের পক্ষে কোনোভাবেই যোগাড় করা সম্ভব না। তাই মেয়েও সুস্থ হবে না, তাঁদের স্বপ্নও আর বাস্তবে রূপ নিবে না। তিনি তাঁর মেয়ের পাশে এসে দাঁড়াতে দেশবাসীসহ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান শুভা বিশ্বাস।
টিনাকে এলাকা ও দেশের সম্পদ উল্লেখ করে প্রতিবেশি শেফালি বেগম জানান, টিনার কৃতিত্বে তারা গর্বিত। টিনার আহত হওয়ার ঘটনায় তারা মর্মাহত। এখন তার চিকিৎসার জন্য যে পরিমাণ টাকা লাগবে, তা সংগ্রহ দরিদ্র এই পরিবারের জন্য কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তিনি টিনার চিকিৎসার জন্য সরকার ও দেশবাসীর সহায়তা চান।