যদি মেরুদণ্ড থাকে, তবেই স্বাধীন হতে পারবেন : ইসিকে রোবায়েত ফেরদৌস

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেছেন, ‘মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, সংসদ—বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। পুলিশের ওপর মানুষের কোনো আস্থা নেই। এমন অবস্থায় কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতি অনুরোধ, যদি মেরুদণ্ড থাকে, সাহস থাকে, তবেই স্বাধীন হতে পারবেন।’
আজ রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইসির সংলাপে এসব কথা বলেন রোবায়েত ফেরদৌস।
অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘অনেক অর্জন থাকার পরও আমরা খুব দুঃখী ও দুর্ভাগা। কারণ আমরা এখনও নির্বাচন প্রক্রিয়া ঠিক করতে পারিনি। কেন একটি জাতি ও রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়? যে রাষ্ট্র তার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারে না, সে জাতি ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের সাবেক তিনজন প্রধান বিচারপতির পরিণতি আপনারা দেখেছেন। একজন প্রধান বিচারপতিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে ৫ আগস্টের আগে। আরেকজনকে মব করে বের করে দেওয়া হয়েছে ৫ আগস্টে। আরেকজন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এখন কারাগারে। আপনারা সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের পরিণতিও দেখেছেন। মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, সংসদ—বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। পুলিশের ওপর মানুষের কোনো আস্থা নেই। এমন অবস্থায় কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনুরোধ, যদি মেরুদণ্ড থাকে, যদি সাহস থাকে, তবেই স্বাধীন হতে পারবেন।’
রোবায়েত ফেরদৌস আরও বলেন, ‘গত ২০ বছরে সব পেশা—শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, রাজনীতিকে কালিমালিপ্ত করা হয়েছে। প্রত্যেকটি পেশার মর্যাদা শেষ করে দেওয়া হয়েছে। সব ভেঙে গেছে। কারও প্রতি কারও কোনো আস্থা বা বিশ্বাস নেই। গতবারও এসেছি, বলেছি, কিন্তু তারা সেই সাহস, মেরুদণ্ড দেখাতে পারেননি। তারা পরিণতি ভোগ করেছেন। সংলাপের দরজা কোনোদিন বন্ধ হয় না। শেষ পর্যন্ত খোলা রাখতে হয়—এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। পুরো পৃথিবী বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। কমিশনকে স্বাধীন ও স্বচ্ছ হতে হবে। আমরা সেটা দেখতে চাই। আইনশৃঙ্খলা কীভাবে রিস্টোর করে কাজ করবেন, এটা বড় চ্যালেঞ্জ। সীমাহীন দুর্নীতির জায়গায় নির্বাচন করতে হবে, তাই প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করতে হবে। আচরণবিধি ভাঙলে দৃশ্যমান শাস্তি আমরা বড়ভাবে দেখিনি। দুর্নীতির জায়গাটাও দেখতে হবে।’
ইসির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে সাংবাদিক, কলামিস্ট সোহরাব হাসান বলেন, ‘আমরা কারিগরি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছি। রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে কম আলোচনা হয়েছে। আমাদের একটা ধারণা হয়েছে—পাঁচজন নির্বাচন কমিশনার মঙ্গল গ্রহ থেকে এসেছেন, সমস্ত কিছুর দায় তাদের। আমরা অন্যায় করব, অনিয়ম করব, ভোট জালিয়াতি করব, চুরি করব, ভোটার আনতে দেবো না—কিন্তু ইসিকে কাজটা করতে হবে। এটা সম্ভব নয়। ইসির প্রতি আমাদের আস্থা আছে কিনা, তার চেয়ে বড় কথা হলো—নির্বাচন কমিশন মনে করে কিনা যে, বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। যদি মনে করে তাহলে পরবর্তীতে নির্বাচনের দায় নিতে হবে। আর যদি মনে না করে তাহলে আগামী পাঁচ মাসে সরকারের কী করা উচিত তা জনসম্মুখে জানাতে হবে। তাহলে ইসির প্রতি জন-আস্থা আসবে।’
এ সময় অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘আপনাদের যেমন নির্বাচন করার মানসিকতা থাকতে হবে, তেমনি নির্বাচন না করার মানসিকতাও থাকতে হবে। যদি মনে করেন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তাহলে নির্বাচন থেকে সরে আসা উচিত। আপনাদের পদত্যাগ করা উচিত। বিগত ইসিকেও একই কথা বলেছিলাম। নির্বাচন মানেই উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা, সেটা না থাকার যথেষ্ট পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো জিততেই হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় যে শক্তি আসবে, আমাদের তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, কিন্তু আমরা তো সেই শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। সব প্রার্থীরা একই মঞ্চে প্রচার করবে, এমন ব্যবস্থা করতে হবে। এতে কালো টাকার প্রভাব কমবে।’
জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মোহন রায়হান বলেন, ‘এখনও প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্বৈরাচারের প্রেতাত্মারা রয়েছে। তারা সুন্দর নির্বাচন হতে বাধা দেবে। এই বিষয়ে ইসিকে সজাগ থাকতে হবে। তবে নির্বাচন অবাধ করতে গেলে প্রথমে প্রয়োজন হবে আপনাদের সদিচ্ছা।’
বিজিএমইএ পরিচালক রশিদ আহমেদ হোসাইন বলেন, ‘শুধু ঋণখেলাপিদের নয়, যারা অর্থপাচারকারী তারাও যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে, সেই আইন করতে হবে।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতিতে জনগণ আপনাদের প্রতি অনেক প্রত্যাশা রাখে। গত ১৫ বছর বা এখনও সহিংসতা নরমালাইজ (স্বাভাবিক) হয়ে গেছে। নির্বাচনের সময় আপনারা এটা কীভাবে মোকাবিলা করবেন, সেটা দেখার বিষয়।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘৫৫ বছর পরও নারীদের জন্য মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ আসনের কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি। এটা মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের ন্যূনতম দাবি—৩৩ শতাংশ আসন নারীদের জন্য নিশ্চিত করা। এ ছাড়া প্রবাসীদের সন্তানরা পড়াশোনার জন্য দেশে থাকে। তাদের নিরাপত্তা ও অংশগ্রহণও গুরুত্ব দিতে হবে।’
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য মোহাম্মদ হারুন চৌধুরী বলেন, ‘স্থানীয় পর্যায়ে ভোটাররা যেন নিরাপত্তা পায়, তা এখনই দৃশ্যমান করতে হবে। অনেক প্রার্থী পোলিং এজেন্ট দিতে পারে না। বড় দলগুলো ভয়ভীতি দেখায়। এটা যেন না হয় তা কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে।’
শিক্ষার্থী প্রতিনিধি জারিফ রহমান বলেন, ‘অদৃশ্য একটা ভয় নির্বাচনের আগে বিরাজ করে। ভোটের আগে দাগী আসামিরা যেন অংশ নিতে না পারে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। নির্বাচন-পরবর্তী নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেন বজায় থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার ঠেকাতে ফ্যাক্ট-চেকিং ও কুইক রেসপন্স টিম গঠন করতে হবে।’
সংলাপের সমাপনী বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমরা নির্বাচনকে স্বচ্ছ করতে চাই। সবাই যাতে দেখতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে চাই। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানাব। দেশি পর্যবেক্ষক যতটা পারি বেশি নিবন্ধন দিতে চাই। আমরা চেষ্টা করব, আপনাদের পরামর্শ বাস্তবায়ন করার। অতীতের মতো হবে না। আমরা অনিয়ম হলে পুরো আসনের নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা ফিরিয়ে এনেছি।’
এ সময় আগত সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশে সিইসি বলেন, ‘আমাদের দরজা সবসময় খোলা। যেকোনো সময়ে আপনাদের সুপারিশ আমরা গ্রহণ করব। কল রেকর্ড ফাঁস হওয়ার ভয়ে টেলিফোনে কথা বলি না। সামনাসামনি অফিসে কথা বলি।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রথম দফার এ সংলাপে প্রথমে ডাক পান সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বুদ্ধিজীবীরা। এতে ৩০ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও সংলাপে অংশ নেন ১৪ জন।
সিইসির সভাপতিত্বে সভায় চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব ও কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া আমন্ত্রিতদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আল মাহমুদ হাসানউজ্জামান, নিরাপত্তা বিশ্লেষক মো. মাহফুজুর রহমান ও অধ্যাপক আব্দুল ওয়াজেদ।
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোটের লক্ষ্য নিয়ে সব প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে ইসি। অক্টোবরে রাজনৈতিক দল, নারী নেত্রী, জুলাই যোদ্ধা, গণমাধ্যমের সঙ্গে সংলাপে বসবে ইসি।
২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে সংলাপের আয়োজন করে ইসি। গত তিন নির্বাচনেও সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও অংশীজন অভিযোগ করেছেন, সংলাপ-পরবর্তী সময়ে তাদের পরামর্শ বা মতামতগুলো আমলে নেয়নি কমিশন।
সর্বশেষ দুটি সংসদ নির্বাচনের সময় দায়িত্বে থাকা সিইসি কে এম নূরুল হুদা মবের কবলে পড়েছিলেন। পরে তাকে একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুজনই এখন কারাগারে।