গুমের শিকার বন্দিদের যেসব নামে ডাকা হতো

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেছেন, গুমের শিকার ব্যক্তির হাত কেটে ফেলা, নখ উপড়ে ফেলা, ঘুর্ণায়মান চেয়ারে বসিয়ে কিংবা ইলেকট্রনিক শক দিয়ে লোমহর্ষক সব নির্যাতন করা হতো। এ ছাড়া গুমের শিকার বন্দিদের আলাদা ‘কোড নেইম’ ছিল।
আওয়ামী লীগের আমলে গুমের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে দুটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর আজ বুধবার (৮ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনাল-১ এ এসব কথা বলেন তাজুল ইসলাম।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, “গুমের শিকার বন্দিদের আলাদা ‘কোড নেইম’ ছিল। বিশেষ বন্দিদের ডাকা হতো ‘মোনালিসা’ নামে। আর গুম-ঘরকে বলা হতো ‘আর্ট গ্যালারি’, যা পরবর্তীতে ‘আয়না ঘর’ হিসেবে পরিচিতি পায়। অন্যদিকে, গোপন বন্দিশালাগুলোকে ‘হাসপাতাল’ বা ‘ক্লিনিক’ নামে ডাকা হতো। আর গুমের শিকার ভুক্তভোগীদের বলা হতো ‘সাবজেক্ট’।”
চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেন, ‘শত-হাজারও তরুণের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলাদেশ। এই দেশকে এই জেনারেশন নতুনভাবে দেখতে চায়।’
শেখ হাসিনার শাসনামলে গুমের শিকার ব্যক্তিদের লোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ননা তুলে ধরে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা কখনোই এখানে আবার গুম-ক্রসফায়ারের সংস্কৃতি ফেরত আসুক কিংবা মানুষের হাত-পা, নাড়ি-ভুঁড়ি কেটে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি আর কখনো ফিরে আসুক; এটা বাংলাদেশের কেউ আর চায় না। সে কারণেই আজকের এই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য আমাদের এই প্রচেষ্টা। ইনশআল্লাহ, আশা করি আইনসম্মত উপায়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এটা নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করা হবে।’
তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘গত ১৫ বছর ধরে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব বাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য, যারা উত্তরায় টিএফআই (টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন) সেলসহ গোপন বন্দিশালায় ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিকসহ তৎকালীন সরকারের কর্মকাণ্ডে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন; সেসব লোকদের আটক রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। এমন হাজারও অভিযোগের মধ্য থেকে কিছু অভিযোগ আমাদের কাছে ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। সেসবের ব্যাপারে আমরা ফরমাল চার্জ দাখিল করেছি।’
জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেন্টার (জেআইসি) প্রসঙ্গে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর বা ডিজিএফআইয়ের কিছু সংখ্যক বিপথগামী সদস্য, যারা জেআইসি নামক যে সেন্টারটি রয়েছে সেই সেন্টারটিকে অপব্যবহার করে রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক বন্দিদের গোপন কারাগারে আটক রেখেছিল। এ নিয়ে আলাদা তদন্ত প্রতিবেদন ও ফরমাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) আমরা দাখিল করেছি।’
‘এসব ঘটনার সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ র্যাব-ডিজিএফআইয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের বেশকিছু কর্মকর্তাকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছি আমরা। এর মাধ্যমে একটা স্পষ্ট বার্তা দিতে চাই, অপরাধ যারা করবেন, যারা আইনকে নিজের হাতে তুলে নেবেন, অপরাধীকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। এটা ন্যায়বিচারের দাবি’, যোগ করেন তাজুল ইসলাম।
চিফ প্রসিকিউটর জানান, টিএফআই সেলে গুমের ঘটনায় শেখ হাসিনা-তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া জেআইসিতে গুমের ঘটনায় এই দুজনসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম বলেন, ‘আজ শেখ হাসিনার আমলে গুমের ঘটনায় আজ ট্রাইব্যুনাল- ১ এ গুমের অভিযোগে দুটি এবং জুলাই আন্দোলনে গুলি করার অভিযোগে বিজিবির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একটি, মোট তিনটি ফরমাল চার্জ দাখিল হয়েছে।’
এ ছাড়া একইদিন রাজধানীর রামপুরায় ২৮ জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিজিবির সাবেক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেদোয়ানুল ইসলামসহ চারজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। যেখানে ছয়টি অভিযোগ আনা হয়েছে। রেদোয়ানুল ইসলাম ছাড়াও অন্য তিন আসামি হলেন—রাফাত বিন আলম মনু, রাশেদুল ইসলাম ও মশিউর রহমান।