আহতদের আর্তনাদে ভারী হাসপাতাল, তবু মেলেনি চিকিৎসা
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশে জুলাই আন্দোলনকারীদের একদিকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী, অন্যদিকে আহত হাজার হাজার মানুষ যাতে চিকিৎসা না পায় সেজন্য শেখ হাসিনা ‘নো ট্রিটমেন্ট নো রিলিজ’ অর্ডার দেন। আহতদের আর্তনাদে হাসপাতালগুলো ভারী হয়ে উঠলেও মেলেনি চিকিৎসাসেবা। এতে বহু আন্দোলনকারী প্রাণ হারান, অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেন, কেউ চোখ হারিয়ে হন অন্ধ।
রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত আন্দোলনকারী আব্দুল্লাহ আল ইমরানের সাক্ষ্যে উঠে আসে শেখ হাসিনা প্রশাসনের এই বর্বরতা। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে এ সাক্ষ্য দেন ইমরান।
জবানবন্দিতে সাক্ষী আব্দুল্লাহ আল ইমরান আদালতে বলেন, ‘২০২৪ সালের ১৯ জুলাই রাজধানীর ফকিরাপুল পানির ট্যাংকির পাশে পুলিশ আমাকে গুলি করে। আমাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। পঙ্গু হাসপতালে নেওয়ার পর দুদিন পড়ে ছিলাম কেউ চিকিৎসা করেনি। কারণ শেখ হাসিনা পরিদর্শনে এসে হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বলে গেছেন—‘নো ট্রিটমেন্ট নো রিলিজ’। আমার পায়ে পচন ধরে যায়, তবু কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি।’
জবানবন্দিতে আব্দুল্লাহ আল ইমরান আরও বলেন, ‘আমি ঢাকা কলেজের দর্শন বিভাগে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে ছিলাম। হলে থাকতাম না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগদান করি। ১৯ জুলাই রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকায় পানির ট্যাংকির পাশে ছাত্ররা আন্দোলন করছিল। এ সময় পুলিশ অতর্কিত ছাত্রদের ওপর গুলি করে। আমার মাথা ও পায়ে গুলি লাগে। আমার পাশে কয়েকজন বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। আমাকে রিফাত ও আতাউর নামে দুই বন্ধু প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়, কিন্তু তারা (চিকিৎসকরা) আমাকে চিকিৎসা দেননি। পরে আমাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তারা (চিকিৎসকরা) আমার পা কেটে ফেলতে চেয়েছিল, কারণ গুলিতে আমার বাম পায়ের গোড়ালির মাংস হাড় থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিল। তবুও আমি পা কাটার অনুমতি দিইনি।
আব্দুল্লাহ আল ইমরান সাক্ষ্যতে আরও বলেন, পরে অ্যাম্বুলেন্সে করে আমাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।সেখানে প্রথম দিন বলেছিল, আপনার পা কেটে ফেলতে হবে। কিন্তু তখনও আমি রাজি হইনি। আমাকে রাত ৮টায় এসে একজন বলল, আপনার কাল অপারেশন হবে। আপনি কিছু খাবেন না। পরের দিন সকালে আমার অপরাশেন করা হয়নি। অথচ পায়ে পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল। এভাবে দুদিন আমাকে ফেলে রাখা হয়।’
আদালতে ইমরান আরও বলেন, ২৬ অথবা ২৭ জুলাই সকাল ৯টা/১০টার দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঙ্গু হাসপাতাল পরিদর্শনে আসেন। একপর্যায়ে শেখ হাসিনা আমার কাছে যান। শেখ হাসিনাকে আমি ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করি। এ সময় শেখ হাসিনা তাকে ‘আপা’ ডাকতে বলেন। এরপর আমি কোথায় পড়াশোনা করি, হলে থাকি কি-না, কেন থাকি না, সে সম্পর্কে শেখ হাসিনা জানতে চান।
জুলাই অভ্যুত্থানে আহত আব্দুল্লাহ আল ইমরান আরও বলেন, একপর্যায়ে শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন, আমি আন্দোলনকারী। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, পুলিশ তোমাকে গুলি করেছে? আমি বলি, পুলিশ আমাকে সরাসরি গুলি করে। পুলিশের পোশাকে কারা ছিল, সেটা আমি জানি না। আমার পর আরও চার থেকে পাঁচজনের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। পরে শেখ হাসিনা যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখন হেল্প ডেস্কের কাছে গিয়ে অর্ডার দেন ‘নো ট্রিটমেন্ট নো রিলিজ’, যা আমি শুনতে পাই। তবে ‘নো ট্রিটমেন্ট নো রিলিজ’ বলতে শেখ হাসিনা কী বুঝাতে চেয়েছেন, তখন আমি বুঝতে পারিনি।
ইমরান আরও বলেন, ৫ আগস্টের পর আমাকে সাধারণ ওয়ার্ড থেকে কেবিনে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা শুরু হয়। তত দিনে আমার পা অবশ হয়ে গেছে। আমার এক পায়ের কোনো শিরা কাজ করে না। শেখ হাসিনার ওই নির্দেশের কারণে আমার চিকিৎসা হয়নি। গত ১১ মাসে আমার ২৫ বার অপারেশন করা হয়, কিন্তু আমি এখনও সুস্থ হইনি, স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারিনি। আমার এ অসুস্থতার জন্য শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল দায়ী। আমি তাদের বিচার চাই।

জাকের হোসেন