শেখ হাসিনা-কামালের রায়, ট্রাইব্যুনাল বসবে বেলা ১১টায়
জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে সোমবার (১৭ নভেম্বর) মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় ঘোষণা করবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত তিনজনের প্যানেল এই রায় ঘোষণা করবেন।
সোমবার বেলা ১১টা রায় ঘোষণা শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যার্টনি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম এবং প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম।
২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণবিক্ষোভে প্রায় এক হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণহানি এবং প্রায় ২৫ হাজার মানুষকে মারাত্মক আহত করার অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে এই মামলা হয়। গত বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) আলোচিত এই মামলার রায়ের দিন ধার্য্য করেন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
চলতি বছরের ১ জুন এই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এই মামলায় মোট ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন নিজের দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়ে ট্রাইব্যুনালে ইতোমধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠা অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের সুনির্দিষ্ট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। এগুলো হলো:
প্রথম অভিযোগ— রাজাকারের বাচ্চা বলে হত্যার উসকানি : ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ও ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ উল্লেখ করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। তার ওই উসকানিমূলক বক্তব্যে উৎসাহিত হয়ে আসাদুজ্জামান খান কামাল, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ব্যাপকহারে পদ্ধতিগতভাবে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর হামলা-আক্রমণ করে। তাদের গুলি ও হামলায় প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-জনতা নিহত হয়। আহত হয় প্রায় ২৫ হাজার মানুষ।
দ্বিতীয় অভিযোগ— প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার : হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে সেই নির্দেশ কার্যকর করেন। ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল এবং ১৮ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে কথা বলেন শেখ হাসিনা। দুজনের সঙ্গে কথোপকথনের পৃথক অডিও রেকর্ড থেকে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোকে মারণাস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা নিজেই।
শেখ হাসিনার সেই নির্দেশ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির মাধ্যমে সব বাহিনীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তার অন্যান্য অঙ্গসংগঠন এবং ১৪ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের কাছেও এই নির্দেশ পৌঁছে যায়। সেই নির্দেশের আলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ দায় বা সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুনের ওপর বর্তায়।
তৃতীয় অভিযোগ— আবু সাঈদ হত্যা : ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে তার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন চারবার পরিবর্তন করা হয়। এ ঘটনার দায় চাপিয়ে নিহত আবু সাঈদের সহপাঠীদের আসামি করে মামলাও করে পুলিশ। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশে এই হত্যা, তথ্য গোপন, আলামত নষ্ট এবং পাল্টা মিথ্যা মামলা করা হয়। এর মাধ্যমে এই তিন আসামি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
চতুর্থ অভিযোগ— চানখারপুলে আনাসসহ ছয় হত্যা : গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে আসার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন চানখারপুল এলাকায় শাহরিয়ার খান আনাসসহ (শহীদ আনাস) ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে এ ছয়জনকে হত্যার নির্দেশ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
পঞ্চম অভিযোগ— আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানো : গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে আসার সময় ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় ছয়জন আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। জঘন্য এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে তাদের মরদেহ পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে আশুলিয়া থানা পুলিশ। এ ঘটনার নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
এ মামলার অভিযোগ গঠনের দিন ১০ জুলাই রাজসাক্ষী হন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তখন ট্রাইব্যুনাল পক্ষ থেকে তাকে দোষ স্বীকারের শর্তে ক্ষমা ঘোষণা করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়। এ মামলায় প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয় ৩ আগস্ট। মোট ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ করা হয়। এ সময় মামলার কার্যক্রম ও শুনানি বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। শুনানিকালে সাক্ষীদের বর্ণনায় উঠে আসে রাষ্ট্রীয় মদদে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নৃশংসতা, সন্তানহারা বাবা-মায়ের আর্তনাদ, চোখ হারানো ও পঙ্গু জুলাইযোদ্ধাদের আহাজারি। দীর্ঘ সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষে ১৬ অক্টোবর থেকে ২৩ অক্টোবর যুক্তিতর্ক চলে। এ সময় সমাপনী বক্তব্য দেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম, আসামীদের আইনজীবী আমির হোসেন এবং অ্যার্টনি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।

নিজস্ব প্রতিবেদক