লটারিতে ডিসি-এসপি নিয়োগ, ইসি থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা করার দাবি
সংসদ নির্বাচনে জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি) ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) অনেক দায়িত্ব থাকে। ডিসিদের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তাদের স্বচ্ছতার ওপর নির্বাচন কেমন হবে, তা অনেকটাই নির্ভর করে। সেজন্য, নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। দলটি নির্বাচন কমিশনকে বলেছে, সুষ্ঠু ভোট আয়োজনে আপনারা শক্ত থেকে দায়িত্ব পালন করবেন।
অপরদিকে লটারির মাধ্যমে জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি) ও ওসি বদলির দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। অনুরূপভাবে, নির্বাচনি পোস্টারে দলীয় প্রধানের বাইরে অন্য কারও ছবি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ব্যবহার করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার জন্য ইসিকে পরামর্শ দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি।
দলগুলোর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সবাইকে আশস্ত করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, একটি সুন্দর নির্বাচন জাতির কাছে সব দলেরই ওয়াদা এবং দেশের মানুষের কাছে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে ওয়াদাবদ্ধ ইসি। আর গণভোট আয়োজনে সরকারের অধ্যাদেশ (আইন) জারির অপেক্ষায় বলে জানান সিইসি।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি ও এনসিপিসহ ১২টি রাজনৈতিক দল গতকাল বুধবার (সকাল-বিকেল) সংলাপে অংশ নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) এসব পরামর্শ ও সুপারিশ জানায়। এ সময় সিইসিসহ তিন নির্বাচন কমিশনার ও ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ইসির সংলাপে বুধবার (১৯ নভেম্বর) বিকেলে অংশ নেয় বিএনপি। ইসির উদ্দেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের একটাই করণীয়—নিয়মনীতি মেনে নির্বাচন করা। আচরণবিধির প্রতিপালন করতেই হবে। এ নিয়ে দ্বিমত নেই।
ড. আব্দুল মঈন খান যোগ করেন, তফসিলের বাইরে যাওয়ার সুযোগ দেখছি না। আমরা যে পরামর্শ দিয়েছিলাম, সবকিছুর প্রতিফলন দেখেনি।
অন্যদিকে, নিয়মনীতি প্রণয়ন প্রসঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে মঈন খান বলেন, যতই অঙ্গীকারনামা নেওয়া হোক, নিজেদের সংশোধন না করলে তা কোনো কাজে আসবে না। এক্ষেত্রে শাস্তির বিধান স্পষ্ট না। যত নিয়মনীতি তৈরি করা হবে, তত লঙ্ঘনের প্রবণতা বাড়বে।
বর্তমান যুগে বাক-স্বাধীনতার নতুন ক্ষেত্র হিসেবে এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) এবং অপতথ্যের উত্থান নিয়েও বিএনপির এই জ্যেষ্ঠ নেতা কথা বলেন। তিনি বলেন, বর্তমান যুগে বাক-স্বাধীনতার নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। তবে কথা বলার স্বাধীনতা যেহেতু দেওয়া হয়েছে, সেহেতু এর অপব্যবহার হবেই।
ড. আব্দুল মঈন খান মনে করেন, দেশ বর্তমানে একটি ক্রান্তিকাল পার করছে এবং এ সময়ে ইসির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ইসিকে তাদের বিদ্যমান লোকবলের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
একইসঙ্গে ইসির নিজস্ব লোকবল থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের দাবি জানিয়ে ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে।
সংলাপে অংশ নিয়ে বুধবার সকালে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আপনারা লক্ষ্য করেছেন—এক মাসও হয়নি, ২০ দিনও হয়নি, একজন ডিসি চলে গেলেন। সেটাও হঠাৎ করে। আবার এক সপ্তাহের মধ্যে অনেককে রদবদল করা হয়েছে। এটার পেছনে মনে হয় যেন কোনো একটা ডিজাইন, একটা উদ্দেশ্যে আছে।
মিয়া গোলাম পরওয়ার আরও বলেন, আমরা যখন এই কথা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনার সময় বলেছিলাম—আপনারা এরকম করেন, কোশ্চেন থাকবে না। তখন সেখানে তার (প্রধান উপদেষ্টা) বক্তব্যে বোঝা গেল, পরিষ্কারভাবে উনি কিছু বলেননি। তবে, আমরা বুঝতে পারলাম কোনোভাবে, কোনো এক জায়গা থেকে কেউ এটা শুরু করেছে। সেটা কি কোনো প্ল্যান? নির্বাচন কমিশনই হচ্ছে নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য তফসিল ঘোষণার পর আমাদের একমাত্র আস্থার জায়গা। সেখানে আমরা আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম, একটা চেঞ্জ আমরা ইতিপূর্বে দু-একটা ইলেকশন কমিশনের সময় দেখেছি, তফসিল ঘোষণার পরেই একদিনে, এক রাতে সব ডিসি-এসপি, পুলিশ সুপারদের রদবদলের ঘটনা ঘটেছে। তাতে আস্থা ছিল; কমপ্লেন ছিল না। এরকম একটা সিদ্ধান্ত না নিলে এখন যা হচ্ছে, এটা একটা পরিকল্পিত ইন্টেনশন।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আরও বলেন, আগামী নির্বাচনের সঙ্গে জুলাই সনদ ও গণভোট—এই দুটো খুবই প্রাসঙ্গিক এই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে। কিন্তু আপনাদের আচরণবিধিতে, ইভেন আপনারা প্রবাসীদের ভোটের ব্যাপারে যে প্রেজেন্টেশন করলেন, এটা পরিষ্কার হয়নি। সেটা হচ্ছে, একই দিনে গণভোট আর জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে এসেছে, গেজেটও সেটা এসেছে।
মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, একই সময়ে নির্বাচনি এলাকায় তিনটা লাউডস্পিকার ব্যবহৃত হতে পারবে। অথচ একটি নির্বাচনি এলাকায় ১৫, ২০, ২১, ১৮, ১৬টা করে ইউনিয়ন আছে। এটা বাড়ানোর সুপারিশ করছি। সন্ত্রাসী, ভোট ডাকাত, যারা বাধা সৃষ্টি করে, নাশকতা করে—তাদের একটু চাপে রাখতে গেলে, ভোটারদের সাহসী করতে গেলে সেনাবাহিনী দরকার। একজন সেনা সদস্য একটা ভোটকেন্দ্রে দিলে এটা খুব বেশি পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব পায় না। সংখ্যাটা একটু বাড়িয়ে অন্তত পাঁচজন সেনা সদস্য একটা ভোটকেন্দ্রে দিলে ভালো হয়।
এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব জহিরুল ইসলাম মূসা বলেন, দলীয় প্রধানের ছবি ছাড়া অন্য কারও ছবি না রাখতে পারার বিধান রাখায় স্বাগত জানাই। এখন খালেদা জিয়া হচ্ছেন বিএনপির প্রধান, তারেক রহমানের বা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ছবি কেউ ব্যবহার করলে এই বিধি ব্যবহার করে ব্যবস্থা নিতে হবে। তখন এই কমিশনের সক্ষমতা আমরা দেখতে পারব।
এ সময় দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, নির্বাচনি জোট করলেও নিজ দলের প্রতীকেই ভোট করতে পারে—এই সিদ্ধান্তে অটল থাকার অনুরোধ জানাব নির্বাচন কমিশনকে।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার রোধে মেটা, টিকটকের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন।
সংলাপে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন জোর দিয়ে বলেন, নির্বাচনি আচরণবিধি প্রতিপালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কমিশনের প্রত্যাশা, সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনি আচরণবিধি পরিপালনে তাদের প্রতিশ্রুতি বজায় রাখবে। তিনি উল্লেখ করেন, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি, যার প্রধান শর্ত আচরণবিধি মেনে চলা।

নিজস্ব প্রতিবেদক