শেখ হাসিনা, রেহানা ও টিউলিপের প্লট দুর্নীতি মামলার রায় আজ
রাজধানীর পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে জালিয়াতির অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, রেহানার মেয়ে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলার রায় জানা যাবে আজ সোমবার (১ ডিসেম্বর)। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক রবিউল আলম এ মামলার রায় ঘোষণা করবেন।
আলোচিত প্লট দুর্নীতির ছয়টি মামলার মধ্যে গত ২৭ নভেম্বর শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে তিনটি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। এরমধ্যে শেখ হাসিনাকে তিন মামলায় ২১ বছরের কারাদণ্ড ও ৩ লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ৬ মাস করে মোট ১৮ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদকে পৃথক ৫ বছর করে কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন এ রায় ঘোষণা করেন।
আরও পড়ুন : লন্ডনে বাড়ি উপহার পান টিউলিপ
এছাড়া শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও মেয়ে আজমিনা সিদ্দিকের বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা শুনানির শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
সরকারিভাবে বরাদ্দ পাওয়া সুধা সদনের তথ্য গোপন, রাজউকের নির্ধারিত ফরমে আবেদন না করা, হলফনামায় অসম্পূর্ণ তথ্য দাখিলের পরও অবিশ্বাস্য দ্রুততায় রাজধানীর নতুন শহর পূর্বাচলের ডিপ্লোমেটিক জোনে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেন জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধু তাই নয়, দুই সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং বোন শেখ রেহানা সিদ্দিক, বোনের দুই সন্তান রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও আজমিনা সিদ্দিকের নামেও বাগিয়ে নেন আরও ৫০ কাঠার প্লট। দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে একাধিকবার ‘রিক্ত আমি, নিঃস্ব আমি, দেবার কিছু নাই….’ বললেও রাষ্ট্রের লক্ষ কোটি টাকা অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হাসিনা পরিবার পূর্বাচলে ৬০ কাঠা প্লটের লোভও সামলাতে পারেননি। এই দুর্নীতিতে শেখ হাসিনাকে প্রভাবিত করেন শেখ রেহানার মেয়ে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক।
আরও পড়ুন : ট্যাক্স রিটার্নে ফ্ল্যাট-জমি দেখালেও হলফনামায় গোপন রেহানার
দুদকের অভিযোগপত্রে বলা হয়, শেখ রেহানার রাজউকের এখতিয়ারাধীন এলাকায় ফ্ল্যাট থাকার পরও হলফনামায় তথ্য গোপন করেছেন। তিনি প্লট আবেদন করার সময় রাজউকের আইন অনুসরণ করেননি। শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক বিশেষ ক্ষমতায় এবং খালা শেখ হাসিনাকে প্রভাবিত করে তার মা, ভাই ও বোনকে প্লট পাইয়ে দেওয়ার দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, শেখ রেহানা সিদ্দিক প্লট পাওয়ার যোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও তিনি মেয়ে টিউপিল সিদ্দিকের মাধ্যমে প্লট বরাদ্দ নেন। হলফনামায় শেখ রেহানা ঢাকার সেগুনবাগিচায় ফ্ল্যাট থাকার কথা না বললেও আয়কর রিটার্নে তিনি ফ্ল্যাটের বিবরণ দিয়েছিলেন। এছাড়া শেখ রেহানা রাজউকে কোনো ধরনের আবেদন না করে তার আপন বোন শেখ হাসিনার কাছে আবদার করেই রাজউকের ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেন।
দুদকের অভিযোগপত্রে বলা হয়, শেখ হাসিনা তার ক্ষমতাবলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ অন্য কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করে শেখ রেহানার নামে প্লট বরাদ্দ দেন। এছাড়া শেখ রেহানার কোনাবাড়িতে ১৬০ শতাংশ কৃষি জমি ছিল। তিনি আয়কর রিটার্নে এই বিষয়ে বললেও হলফনামায় গোপন করেছেন। এছাড়া তার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকও আয়কর রিটার্নে সম্পত্তির রয়েছে বললেও হলফনামায় গোপন করেছেন। অপরদিকে শেখ রেহানা সিদ্দিকের বড় মেয়ে আজমিনা সিদ্দিকও আয়কর রিটার্নে গুলশানে ফ্ল্যাট রয়েছে বললেও হলফনামায় গোপন করেছেন।
আরও পড়ুন : ভাই-বোনের প্লট পেতেও প্রভাব খাটান টিউলিপ
অভিযোগপত্রে বলা হয়, টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক বর্তমানে যুক্তরাজ্যের হ্যাম্পস্টেড এবং হাইগেট অঞ্চলের ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। টিউলিপ ব্রিটেনে বসে জানতে পারেন, তার খালা শেখ হাসিনা, ছেলে সজীব আহমেদ ওয়াজেদ (জয়) ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দ নিচ্ছেন। সে সময় তিনি ব্রিটিশ এমপির প্রভাব দেখিয়ে মা রেহানা সিদ্দিক, বোন আজমিনা সিদ্দিক ও ভাই রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের নামে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।
এতে আরও বলা হয়, দ্য ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (অ্যালটমেন্ট অব ল্যান্ডস) রুলস ১৯৬৯-এর ৯ বিধি সাপেক্ষে, ট্রাস্ট এমন ব্যক্তিকে প্লট বরাদ্দ করতে পারে যারা সরকারি চাকরি, জনসেবা কিংবা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। তবে এই বিধি অনুযায়ী, কেউ নির্ধারিত ফরমে আবেদন না করলে এবং সরকার সুপারিশ না করলে তিনি বা তারা প্লট বরাদ্দ পাবেন না।
শুনানিকালে গ্রেপ্তারকৃত একমাত্র আসামি রাজউকের সদস্য খোরশেদ আলমের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আইনজীবী শাহীনুর ইসলাম। তবে মামলার অন্য আসামিরা পলাতক থাকায় তাদের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সুযোগ ছিল না।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, রেহানা সিদ্দিক অসৎ উদ্দেশ্যে আপন বোন শেখ হাসিনাকে প্রভাবিত করে রাজউকে কোনো আবেদন না করেই সরকারি জমি আত্মসাৎ করে ভোগদখল রেখেছেন। যা দণ্ডবিধির ১৬১, ১৬৩, ১৬৪, ১৬৫(ক), ৪০৯, ৪২০, ১০৯ এবং দুদক আইনের ৫ (২) ধারায় অপরাধ করেছেন।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, রেহানা সিদ্দিক ও পরিবারের অন্য সদস্যদের রাজউক এলাকায় ফ্ল্যাট থাকার পরও হলফনামায় তথ্য গোপন করেছেন। তিনি পূর্বাচল নতুন শহর আবাসন প্রকল্পে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। তিনি রাজউকের আইন, বিধি ও নীতিমালা মানেননি এবং তার মেয়ে টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে ও বোন শেখ হাসিনার ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্লট বরাদ্দসহ রেজিস্ট্রি করে দখল নিয়েছেন।
আরও পড়ুন : হাসিনার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর যেন খালেদা জিয়া দেখে যেতে পারেন : হাসনাত আব্দুল্লাহ
এ মামলায় শেখ রেহানা ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন– টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক, শেখ হাসিনা, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সরকার, সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদার, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. অলিউল্লাহ, অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) কাজী ওয়াছি উদ্দিন, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা, রাউজকের সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) খুরশীদ আলম, রাউজকের সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাস, রাউজকের সাবেক সদস্য পরিকল্পনা নাসির উদ্দিন, রাজউকের সাবেক সদস্য সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী, সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি) মাজহারুল ইসলাম, রাজউকের উপপরিচলক নায়েব আলী শরীফ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন, সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহম্মেদ। রাজউকের কর্মকর্তা খুরশীদ আলম ছাড়া বাকি সব আসামি বর্তমানে পলাতক আছেন।

নিজস্ব প্রতিবেদক