এনসিপিনেতা পরিচয়ে সাংবাদিকদের তালাবদ্ধ করার হুমকি
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা ও জুলাইযোদ্ধা পরিচয়ে সাংবাদিকদের তালাবদ্ধ করার হুমকি দিয়েছেন দুজন। আজ সোমবার (১ ডিসেম্বর) বিকেলে রাজশাহীর পর্যটন মোটেলে সংবাদ সম্মেলনে তারা সাংবাদিকদের হেনস্তার পর তারা তালাবদ্ধ করে রাখার হুমকি দেন।
সদ্য ঘোষিত রাজশাহী জেলা কমিটির আহ্বায়কসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ‘আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ ও জুলাই আন্দোলনের বিরোধিতা করার অভিযোগ উঠেছে। সদ্য ঘোষিত এই কমিটি বিলপ্ত করতে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে দলটির একটির পক্ষ। গতকাল রোববার রাতে রাজশাহী নগরীর গণকপাড়া মোড়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এই আলটিমেটাম দেন। পরে তারা জেলার নতুন আহ্বায়ক সাইফুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজনের কুশপুত্তলিকা দাহ করেন।
আজ বিকেলে নিজের অবস্থান তুলে ধরে পর্যটন মোটেলে সংবাদ সম্মেলন করছিলেন জেলার আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম। এ সময় দুজন এনসিপির নেতা ও জুলাইযোদ্ধা পরিচয়ে সাংবাদিকদের হেনস্তা ও তালাবদ্ধ করার হুমকি দেন। পরে সাংবাদিকরা এর প্রতিবাদ করলে তারা দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
সাংবাদিকদের তালাবদ্ধ করে রাখার হুমকিদাতারা হলেন শোয়েব ও মেহেদী। তারা এনসিপির কোনো পদে না থাকলেও দলটিতে ব্যাপক সক্রিয় বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী জেলার নবগঠিত আহবায়ক কমিটি আজ বিকেলে রাজশাহী পর্যটন মোটেলে পরিচিতি সভা ও জেলার আহ্বায়ককে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করছিলেন। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে প্রায় ৩০ যুবক এনসিপির নেতা ও জুলাই যোদ্ধা পরিচয়ে জেলা কমিটির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলামকে আওয়মী লীগের দোসর বলে তাদের কর্মসূচি ভণ্ডুল করার চেষ্টা চালায়। এ সময় এনসিপির দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে মহাহানগর এনসিপির দুই কর্মী সংবাদ সম্মেলন চলাকালে সভাকক্ষে ঢুকে সংবাদিকদের দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করার আলটিমেটাম দেন। অন্যথায় পর্যটন মোটেলে তালাবদ্ধ করে ভেতরে আগুন দেওয়ারও হুমকি দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন কর্মরত সংবাদিকরা। তারা একাট্টা হয়ে হুমকিদাতা দুজনকে পর্যটন মোটেলের বাইরে বের করে আনেন। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে তাদের সঙ্গে সংবাদিকদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। পরে পুলিশ গিয়ে দুই পক্ষকে শান্ত করে। সংবাদকর্মীরা তাৎক্ষণিক এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করেন।
এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত এনসিপির সব কার্যক্রমের সংবাদ সংগ্রহ থেকে বিরত থাকবেন বলেও জানান সাংবাদিকরা।
গত শনিবার রাতে এনসিপি রাজশাহী জেলা ইউনিটের ১০৫ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। সম্প্রতি বিলুপ্ত হওয়া সমন্বয় কমিটির যুগ্ম সমন্বয়ক সাইফুল ইসলামকে করা হয়েছে নতুন কমিটির আহ্বায়ক। অভিযোগ উঠেছে, তিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, অস্ত্রধারী যুবলীগ ক্যাডার জহুরুল ইসলাম রুবেল যিনি ২৪-এর ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার মিছিলে দুই হাতে গুলি চালিয়েছেন সেই রুবেলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন এই সাইফুল। এনসিপির জেলা আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর যুবলীগ ক্যাডার রুবেলের সঙ্গে জেলার নতুন আহ্বায়ক সাইফুল ইসলামকে একটি কর্মসূচিতে পাশাপাশি অবস্থানের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।
সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করতে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক নেতা পরিচয় দেওয়া সুমাইয়া আক্তার অভিযোগ করেন, নতুন কমিটিতে আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজনকে রাখা হয়েছে। তার দাবি, আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং যুবলীগনেতা জহুরুল ইসলাম রুবেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখতেন—যিনি ৫ আগস্ট রাজশাহীতে ছাত্রজনতার মিছিলে দুই হাতে পিস্তল নিয়ে গুলি করার ঘটনায় বর্তমানে কারাগারে আছেন।
সুমাইয়া বলেন, ‘এই কমিটি জুলাইয়ের শহীদদের প্রতি অপমান। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কমিটি বাতিল না হলে আমরা আবার রাস্তায় নামব।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সাবেক নেতা আব্দুল বশীর আল হাদি জানান, সাইফুলের রাজনৈতিক যোগাযোগ নিয়ে তারা দীর্ঘদিন ধরেই এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন ‘রাজশাহীর শীর্ষ আওয়ামী লীগনেতাদের সঙ্গে তার (সাইফুল ইসলাম) ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাঁকে জেলা আহ্বায়ক করা হয়েছে—এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
সংবাদ সম্মেলন শেষে তারা ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এনসিপির রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইমরান ইমন এবং জেলা আহ্বায়ক সাইফুল ইসলামের কুশপুত্তলিকা দাহ করে।
এদিকে সংবাদ সম্মেলনে সাইফুল ইসলাম এসব অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন, বিভ্রান্তিকর ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, অভিযোগগুলো পুরোনো ছবি, ভিডিও ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভুল ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে তৈরি।
এ বিষয়ে জানতে এনসিপির উত্তরাঞ্চলের সমন্বয়ক সারজিস আলমকে মুঠোফোন একাধিকবার ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
এরপর এ বিষয়ে জানতে দলটির রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইমরান ইমনকেও মুঠোফোনে কল করা হয়, তবে তিনিও কোনো সাড়া দেননি।
এনসিপির রাজশাহী মহানগরের আহ্বায়ক মোবাশ্বের আলী বলেন, ‘সাংবাদিকদের সঙ্গে যে ব্যবহারটা হয়েছে সত্যি দুঃখজনক, এটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। সাংবাদিকদের সঙ্গে এমন আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। সাংবাদিকদের সঙ্গে তো কারো কোনো বিরোধ থাকতে পারে না।’
মোবাশ্বের আলী আরও বলেন, ওরা (অভিযুক্তরা) এনসিপির সমর্থক, আমাদের দলের কোনো পদে নেই। ওরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছিল, সেই হিসেবে জুলাইযোদ্ধা এবং সবসময় আমাদের সঙ্গেই এনসিপির জেলা-মহানগরের প্রোগ্রামে থাকে। তারা কেউ ছাত্রশক্তি কমিটি হলে সেখানে আসতে চায়।’

আবু সাঈদ রনি, রাজশাহী (সদর-গোদাগাড়ী-পবা)