হার না মানা সাতক্ষীরার সেউতি
শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। ছোটবেলা যখন দেখতেন তাঁরই বয়সের ছেলেমেয়েরা হেসেখেলে বেড়াচ্ছে ও লেখাপড়া করছে অথচ নিজে হাঁটতে পারছেন না। এই কষ্টকে শক্তি মনে করে তিনি তাঁর স্বপ্নের পথ ধরেছেন। আর এই স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে অর্জন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি।
ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণি পেয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী সাতক্ষীরার শাহিমা সুলতানা সেউতি প্রমাণ করেছেন ধৈর্য ও সাহসিকতাই একটি বড় শক্তি।
সেউতি এখন মাস্টার্স পাশ করে তাঁর গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঘোনা ইউনিয়নের ঘোনা গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে রয়েছেন। নিজের শক্তিতে তাঁর চলাফেরা করার ক্ষমতা নেই। হুইল চেয়ারে করে চলতে হয়। তাঁর দুই পা পুরোপুরি শক্তিহীন এবং কোমরে কোনো ধরনের শক্তি নেই। যে কারণে তিনি নিজের শক্তিতে দাঁড়াতে বা হাঁটতে পারেন না।
শাহিমা সুলতানা সেউতি বলেছেন, ‘মানুষের স্বপ্ন থাকে। আমারও স্বপ্ন আছে। আমি সেই স্বপ্ন পূরনের লক্ষ্যে এতদূর অগ্রসর হয়েছি। এখন একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলে আমার স্বপ্ন পূরণ হবে। আমাকে যাতে প্রতিবন্ধী হিসেবে সমাজে অবহেলিত হয়ে না থাকতে হয় সেটাই আমার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন পূরণে সরকার একটু সহায়তা করলে আমার জীবন চলৎশক্তি ফিরে পাবে। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক আমার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করে দিয়েছেন। এজন্য তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাই। এখন দরকার একটি চাকরি। তার আগে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ।’
সেউতির বাবা মো. আব্দুর রকিব বলেন, ‘বাংলাদেশে চিকিৎসার চেষ্টা করেছি। কিন্তু লাভ হয়নি। বিদেশে নিতে হলে প্রচুর টাকার প্রয়োজন। সেই টাকা না থাকায় মেয়েটির চিকিৎসা করাতে পারিনি।’
২০০৯ সালে এসএসসি, ২০১১ সালে এইচএসসি এবং ২০১৬ সালে অনার্স পাস করার পর স্নাতকোত্তর করেছেন ২০১৮তে। ঘোনা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রথম শিক্ষা নিয়েছেন। এরপর ঘোনা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সীমান্ত আদর্শ কলেজ এবং সর্বশেষ সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ থেকে তাঁর লেখাপড়া শেষ করেছেন।
সেউতির মা জাহানারা খাতুন বলেন, ‘আমরা চিরদিন বেঁচে থাকব না। ওকে দেখার জন্য একজন লোক দরকার। আমরা অসহায় পরিবার। আমার মেয়ে যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সেজন্য তাঁর একটি চাকরি দরকার।’
প্রতিবেশীরা বলেন, আমরা মেয়েটিকে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া শিখতে দেখেছি। তাঁর বাবা ও ভাই তাঁকে রোজই ঠেলাগাড়ি অথবা হুইল চেয়ারে করে স্কুল-কলেজে নিয়ে যেতেন। কলেজের চারতলায় পরীক্ষার হলে সেউতির বাবা আব্দুর রকিব তাঁকে ঘাড়ে করে নিয়ে উঠতেন। সেউতির ছোট ভাই হৃদয়সহ বাবা ও মা তার দেখাশোনা করেন। হৃদয় তাঁর বোনের শারীরিক পরিচর্যা করে দেন।
সেউতি তাঁর গ্রামের ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়াতেন। কিন্তু করোনাকালে স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ছেলেমেয়েরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এখন টিউশনিও বন্ধ। একটি দরিদ্র পরিবারে বাবা-মায়ের ওপর নির্ভর হয়ে নারী হিসেবে কতদিন বেঁচে থাকা যায়।
গ্রামবাসীও সেউতির প্রতি সহানুভূতিশীল। তারাও চান মেয়েটির একটি চাকরি হোক। এমনকি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও চান সেউতি প্রতিবন্ধী হিসেবে যেন অবহেলিত হয়ে না থাকে।
ঘোনা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ ফজলুর রহমান বলেন, ‘সেউতি মেয়েটি খুব প্রতিভাবান ও প্রতিবাদী মেয়ে। তাঁর শারীরিক অক্ষমতার কারণে চলাফেরা বাধাগ্রস্ত হয়। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক তাঁকে একটি ঘর দিয়েছেন। এখন তাঁর দরকার একটি চাকরি। আমরা সবাই সেই চেষ্টা করছি।’