রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া কোটা বৈষম্যবিরোধীদের স্মারকলিপিতে যা আছে
কোটা সংস্কারের একদফা দাবিতে গণপদযাত্রায় পুলিশের বাধা ও বেরিকেড ভেঙে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন কোটাবিষয়ক বৈষম্যবিরোধীরা। আজ রোববার (১৪ জুলাই) বিকেল ৩টার দিকে তারা এ স্মারকলিপি জমা দেন। প্রতিনিধিদলের কাছ থেকে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব স্মারকলিপি গ্রহণ করেন।
রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া স্মারকলিপির একটি কপি এসেছে এনটিভি অনলাইনের এ প্রতিবেদকের কাছে। স্মারকলিপিতে আন্দোলনরতরা যা বলেছেন তা তুলে ধরা হলো—
‘জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরির সকল গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কার করে আইন প্রণয়ণ প্রসঙ্গে’
স্মরাকলিপিতে শিক্ষার্থীরা বলেছেন, যথাযথ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক নিবেদন এই যে, সাম্প্রতিক সময়ে চলমান কোটা সংস্কার সংক্রান্ত বিতর্কের প্রেক্ষিতে আমরা চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আপনার কাছে নিম্নোক্ত বক্তব্য পেশ করছি।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, আপনি অবগত আছেন যে, ২০১৮ সালে সারা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের গণআন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকারি চাকরি (নবম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেড) থেকে কোটা পদ্ধতি বিলুপ্ত করা হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে জাতীয় সংসদে কোটা বিলুপ্তির ঘোষণা দেন। ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সরকারি চাকরির কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের ঘোষণা দিয়ে পরিপত্র জারি করা হয়। কোটা সংস্কার ছিল শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের প্রাণের দাবি। বৈষম্যমুক্ত ও মেধাভিত্তিক বাংলাদেশ নির্মাণে চাকুরিতে কোটা পদ্ধতির পুনর্বিবেচনা করে কোটার যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছিল শিক্ষার্থীরা। সরকার সার্বিক বিবেচনায় নবম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেডে কোটার বিলুপ্তিকে সমাধান মনে করেছিল। ২০১৮ সালের এই পরিপত্র জারি হবার পরে কোটামুক্তভাবে কয়েকটি সরকারি চাকরির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
কিন্তু, ওই পরিপত্রটি সংবিধানের আলোকে ত্রুটিযুক্ত থাকায় ২০২১ সালে ৬ ডিসম্বর মহামান্য হাইকোর্ট একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এই পরিপত্র কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না মর্মে রুল জারি করেন এবং গত ৫ জুন এই রুলকে অ্যাবসলিউট হিসেবে রায় দেন আদালত।
রায়ে এই পরিপত্রকে হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেন। যার ফলে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডের চাকরির নিয়োগে কোটা পুনর্বহাল হয়। পরবর্তীতে গত বুধবার (১০ জুলাই) সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর এক মাসের স্থিতাবস্থা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ২০১৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলে পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায়ের কিছু অংশ গত বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। রায়ে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে কোটা পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করতে পারবে।
আমরা মনে করি, ২০১৮ সালের পরিপত্রে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে নাই। কেননা শিক্ষার্থীরা সকল গ্রেডের সরকারি চাকরিতে কোটার যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছিল। প্রথমত, কোটার অসহনীয় মাত্রা মানে দেশের লাখো তরুণ-তরুণীদের দাবি ও আন্দোলনের সাথে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রহসন। মুক্তিযুদ্ধের যে মূলমন্ত্র সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার তা নিশ্চিত করতে ও একটি দক্ষ প্রশাসন গড়তে মেধাভিত্তিক নিয়োগের কোনো বিকল্প নেই।
দ্বিতীয়ত, কোটা পদ্ধতি না থাকলে নাগরিকদের অনগ্রসর অংশ প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ থেকে বঞ্চিত হবে। তৃতীয়ত, উক্ত পরিপত্রটি শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারির চাকরির জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে পাঁচ শতাংশ কোটাকে ছাত্রসমাজ যৌক্তিক মনে কর। তাই আমাদের দাবি হচ্ছে—সরকারি চাকরিতে সকল গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠী ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের জন্য কোটাকে ন্যায্যতার ভিত্তিতে ন্যূনতম পর্যায়ে (সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ) এনে সংসদে আইন পাস করে কোটা পদ্ধতিকে সংস্কার করতে হবে।
মহামান্য, ছাত্রসমাজের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে আপনার নিকট আকুল আবেদন জানাচ্ছি যে, জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরিতে সকল গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কার করে বাধিত করবেন। মহামান্য, হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে কোটা পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করতে পারবে। ছাত্রসমাজ দীর্ঘদিন যাবৎ ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে রাজপথে ঝড়-বৃষ্টি-খরতাপকে উপেক্ষা করে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। অথচ, সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের দাবি মেনে নেওয়ার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আমাদের কারণে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হোক তা আমরা কখনোই চাই না। আমরা দ্রুতই পড়ার টেবিলে ফিরে যেতে চাই। ছাত্রসমাজ আশা রাখে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরিতে সকল গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কার করতে উদ্যোগ গ্রহণ করে বাধিত করবেন। অন্যথায়, ছাত্রসমাজ নিজেদের অধিকার রক্ষায়, বৈষম্যমুক্ত ও মেধাভিত্তিক বাংলাদেশ নির্মাণে সর্বাত্মক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য হবে।