ফিরে দেখা ২০২১ : আর্জেন্টিনার শিরোপা জয় ও ইতালির রূপকথা
দেখতে দেখতে বছর শেষ হতে চলল। করোনার মহামারিতে ক্রীড়াঙ্গনের অন্যান্য বিভাগের চেয়ে উত্তাপ কিছুটা বেশিই ছিল আন্তর্জাতিক ফুটবলে। যার বড় কারণ—২৮ বছর পর আর্জেন্টিনার শিরোপা জয়। ২০২১ সালে কোপা আমেরিকার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা।
শুধু কি কোপা আমেরিকা? উত্তাপ ছড়িয়েছে ইউরোপের জমজমাট ফুটবল মহারণ ইউরো। যেখানে সবাইকে চমকে দিয়ে রূপকথার গল্প লিখল ইতালি। সবমিলিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে বিদায়ী বছর কেমন কাটল, তা পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো।
আর্জেন্টিনার অপেক্ষার অবসান
ফুটবলে এ বছরের সবচেয়ে চমক ছিল আর্জেন্টিনার কোপা আমেরিকা জয়। দীর্ঘ ২৮ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ট্রফির দেখা পায় লাতিন আমেরিকার দলটি। আক্ষেপ পূরণ হয় সময়ের সেরা তারকা লিওনেল মেসিরও। ক্লাব ফুটবলে যাঁর ভুরি ভুরি রেকর্ড-শিরোপা, ব্যক্তিগত অর্জনও ছিল—সেই মেসির জাতীয় দলের ক্যারিয়ার ছিল শূন্যতায় ঘেরা। তিনটি কোপা আমেরিকা এবং একটি বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠেও ট্রফি ছোঁয়ার ভাগ্য হয়নি তাঁর। ক্যারিয়ারের প্রায় শেষ লগ্নে এসে মেসি এবার পেয়ে গেলেন শিরোপার দেখা।
এবারের কোপা আমেরিকার ফাইনালে ব্রাজিলকে হারিয়ে শিরোপা উঁচিয়ে ধরেন আর্জেন্টিনার অধিনায়ক মেসি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সব ব্যর্থকে পেছনে ফেলে মেসি পেলেন শিরোপার মুকুট।
কোপায় অনন্য মেসি
কোপা আমেরিকায় পুরো টুর্নামেন্টে মেসি নিজেও ছিলেন অনন্য। নিজে গোল করেছেন এবং সতীর্থদের দিয়ে গোল করিয়ে পুরো টুর্নামেন্টে দারুণ দারুণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। কোপার ফাইনালে সতীর্থরাও যেন তাঁর জন্যই উজাড় করে দিয়েছেন। ম্যাচটির শেষ বাঁশি বাজতে সে দৃশ্যটুকুই ফুটে ওঠে। ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচ শেষে সাইডলাইনে হাঁটু গেড়ে বসে আনন্দের কান্নায় ভেঙে পড়েন মেসি। মুহূর্তের মধ্যে সতীর্থরাও ছুটে এসে মেসিকে ঘিরে ধরেন। এ বছরের ফুটবলের সবচেয়ে সুন্দরতম মুহূর্ত নিশ্চিতভাবে হতে পারে এটি।
ইতালির রূপকথা
ফুটবলের অন্যতম পরাশক্তি হয়েও ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে উঠতে পারেনি ইতালি। বাছাইপর্ব থেকেই ছিটকে গিয়েছিল তারা। ওই ছিটকে যাওয়াই হয়তো বদলে দিয়েছিল ইতালিকে। বিশ্বকাপের দুঃখ পেছনে ফেলে কোচ রবার্তো মানচিনির অধীনে ইউরোতে দেখা গেল উজ্জ্বীবিত ইতালিকে। মানচিনির হাত ধরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে ইতালীয়রা। ইউরোতে সবাইকে চমকে দিয়ে অপরাজিত হয়ে ফাইনালে ওঠে তারা। ফাইনালেও তাদের জয়ের রথ ভাঙতে পারেনি টুর্নামেন্টের আরেক হটফেভারিট দল ইংল্যান্ড। ফাইনাল মঞ্চে ইংল্যান্ডকে কাঁদিয়ে ইউরো জয়ের রূপকথার গল্প লেখে ইতালি।
চ্যাম্পিয়নস লিগে চেলসির চমক
ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে বড় মঞ্চ চ্যাম্পিয়নস লিগ। ইউরোপসেরা এ প্রতিযোগিতায় এবার বড় চমক দিল চেলসি। পিএসজি থেকে চাকরি হারিয়ে চেলসির দায়িত্ব নেন কোচ টমাস তুখেল। দায়িত্ব পাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই চেলসির চেহারাই বদলে দেন জার্মান কোচ।
বছরের শুরুতেও চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা জয়ে চেলসিকে যারা গোনায় ধরেনি, তাদের সবাইকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চেলসিই হলো ইউরোপসেরা। এ প্রতিযোগিতার শক্তিশালী দল ম্যানচেস্টার সিটিকে ফাইনালে হারিয়ে শিরোপা জিতে টমাস তুখেলে চেলসি।
প্রিমিয়ার লিগ দিয়ে আক্ষেপ পূরণ
চ্যাম্পিয়নস লিগে চেলসির কাছে হতাশ হয়েছে পেপ গার্দিওয়ালার ম্যানচেস্টার সিটি। ইউরোপসেরা প্রতিযোগিতার শিরোপার আক্ষেপ তারা পূরণ করল ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ দিয়ে। লিভারপুলের জয়ের রথ এবং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের চ্যালেঞ্জ ভেঙে এবারের প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা পুনরুদ্ধার করে সিটি।
লা লিগায় অ্যাথলেটিকোর উত্থান
লা লিগায় অন্যতম দল অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ। কিন্তু, লিগজুড়ে দুর্দান্ত করেও দীর্ঘদিন ধরে তাদের শিরোপা অধরা ছিল। অবশেষে, এ বছরই তাদের অপেক্ষার অবসান হলো। শক্তিশালী বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদের মতো দলগুলোকে হটিয়ে লা লিগার শিরোপা উঁচিয়ে ধরে দিয়েগো সিমেওনের দল।
লিওনেল মেসির ঘর ছাড়া
এ বছরের আরেকটি বড় আলোচনার বিষয় ছিল—লিওনেল মেসির বার্সেলোনা ছাড়ার ব্যাপারটি। মাত্র ১৩ বছর বয়সে টিস্যু পেপারে চুক্তিতে বার্সায় নাম লেখান মেসি। সেই মেসি সময়ের সঙ্গে হয়ে ওঠেন ক্লাবটির প্রাণভোমরা। দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে ক্লাবকে যেমন দুহাত ভরে দিয়েছেন তিনি, তেমনি ব্যক্তিগত অর্জনেও সমৃদ্ধ করেছেন নিজের ক্যারিয়ার। এত বছর যে ক্লাবে কাটালেন, নাটকীয়ভাবে সেইক্লাবকে ২০২১ সালেই বিদায় জানিয়ে দিয়েছেন আর্জেন্টাইন তারকা।
অবশ্য অনেকটা নিয়মের বেড়াজালে পড়ে মেসিকে স্পেন ছাড়তে হয়। আর্জেন্টাইন তারকা ও বার্সেলোনা দুই পক্ষই নতুন চুক্তির জন্য একমত হয়েছিল। কিন্তু, লা লিগার বেতন কাঠামো মেসির সঙ্গে নতুন চুক্তিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে চোখের জলে শেষ পর্যন্ত প্রিয় ক্যাম্প-ন্যু ছাড়তে ক্লাবটির ইতিহাসের রেকর্ড শিরোপাজয়ী ও রেকর্ড গোলদাতাকে। স্পেন ছেড়ে প্যারিসে পাড়ি জমান মেসি। আর্জেন্টাইন তারকার নতুন ঠিকানা প্যারিসের ক্লাব পিএসজি।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ঘরে ফেরা
লিওনেলি মেসির বুকে যখন ঘর ছাড়ার আর্তনাদ, সময়ের আরেক তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর তখন ঘরে ফেরার উচ্ছ্বাস। কারণ এ বছরই যে নিজের পুরোনো ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ফিরেছেন রোনালদো। এ বছর জুভেন্টাসের কাছে অনেকটা বোঝাই হয়ে পড়েছিলেন পর্তুগিজ তারকা। ফলে, শেষ পর্যন্ত দলবদলের খাতায় নাম লেখাতে হলো তাঁকে। তবে, দল বদলের বাজারে রোনালদো ফিরে পেলেন নিজের পুরো ক্লাব ম্যানইউকে।
মেসির হাতে সপ্তম ব্যালন ডি’অর
এ বছরের পুরোটা সময়ই লাইমলাইটে ছিলেন লিওনেল মেসি। কোপা জয়, বার্সা ছাড়ার পাশাপাশি বছর শেষে আরেকবার আলোচনায় আসেন তিনি। নতুন ক্লাবে এখনও তেমন সাফল্য না পেলেও জাতীয় দলকে ট্রফি এনে দিয়ে রেকর্ড সপ্তমবারের মতো ব্যালন ডি’অরের পুরস্কার জেতেন মেসি। অবশ্য এর আগেও সর্বোচ্চবার ব্যালন ডি’অর জয়ের মালিক ছিলেন মেসি। এবার সে সংখ্যাটাকে আরও উঁচুতে নিয়ে গেলেন পিএসজি সুপারস্টার। এ পুরস্কার জেতাতে মেসির ধারে-কাছেও নেই এখন। মেসির পর দ্বিতীয় সংখ্যকবার এ পুরস্কার জিতেছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। পাঁচবার ব্যালন ডি’অর জেতা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এবার ষষ্ঠ হয়েছেন।
আগুয়েরোর কান্নাভেজা বিদায়
ফুটবল কখনও মানুষকে কাঁদায়, আবার কখনও হাসায়। এ বছর যেমন অনেক আনন্দের উপক্রম ছিল, তেমনি ছিল বেদনার সুরও। বছরের শেষ দিকে কান্না ভেজা কণ্ঠে ফুটবলকে বিদায় বলে দিলেন আর্জেন্টাইন তারকা সার্জিও আগুয়েরো। অনেক স্বপ্ন নিয়ে এ বছরই বার্সায় পা রাখেন তিনি। কিন্তু, স্বপ্ন যে এত দ্রুত ভেঙে যাবে, সেটা কে জানত। অক্টোবরে আলাভেসের বিপক্ষে ম্যাচে বুকে ব্যথা নিয়ে মাঠ ছাড়েন তিনি। সে ব্যথাই কাল হয়ে দাঁড়ায়। একপর্যায়ে জানা যায়, তাঁর হৃদ্স্পন্দন অনিয়মিত। যেটা তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ারকে আর দীর্ঘায়িত হতে দিল না। শারীরিক সমস্যার কারণে বিদায় জানিয়ে দিতে হলো প্রিয় ফুটবলকে।
এরিকসেনের জীবনে ফেরা
শুধু আগুয়েরোই নয়, ফুটবল ভক্তদের কাঁদিয়েছিল খেলার মাঠে এরিকসনের জীবনযুদ্ধও। ইউরোর দ্বিতীয় দিনের ঘটনা। ফিনল্যান্ডের বিপক্ষে সেদিন খেলা চলাকালীন হঠাৎ করে মাঠিয়ে লুটিয়ে পড়েন ডেনমার্কের ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন। হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল তাঁর। তড়িঘড়ি খেলা বন্ধ করা হয়। মাঠে ডাকা হয় চিকিৎসকদের। দ্রুত শুরু হয় হৃদ্স্পন্দন চালু করার কাজ। মাঠে প্রাথমিক চিকিৎসা না পেলে হয়তো সেদিন আর জীবনে ফেরা হতো না তাঁর। এরিকসনের লুটিয়ে পড়ার মুহূর্তটুকু কাঁদিয়েছিল সারা বিশ্বের হাজারও ফুটবল ভক্তদের। ভক্তদের ভালোবাসায় জীবনে ফিরেছেন এরিকসনেও। এবার পুরোপুরি সুস্থ হয়ে মাঠে ফেরার অপেক্ষা ডেনিশ তারকার।