লেগুনার হেলপার সেজে আসামি গ্রেপ্তার, হত্যার রহস্য উন্মোচন
গত ২২ জানুয়ারি শনিবার রাজধানী ঢাকার মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে একটি লেগুনা থেকে অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তিকে ফেলে দেওয়া হয়। পথচারীরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরের দিন যাত্রীবাড়ী থানায় এ ঘটনায় মামলা হয়।
মামলা তদন্তের দায়িত্ব পড়ে যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বিলাল আল আজাদের ওপর। আটঘাট বেঁধে তদন্তে নামেন তিনি। চলে যান সিসি ক্যামেরার ফুঁটেজ নিতে। কিন্তু মেলে না উপযুক্ত সূত্র। শুধু দেখতে পান, চলন্ত লেগুনা থেকে কয়েকজন এক ব্যক্তিকে ফেলে চলে যাচ্ছে। কিন্তু, ওই ফুটেজে লেগুনার নম্বর না পেয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। তবে দেখেন লেগুনার পা-দানি লাল। লাল পা-দানির সূত্র ধরেই এগোতে থাকেন তিনি।
বিলাল আল আজাদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘লাল পা-দানির লেগুনা খুঁজতে লেগুনায় হেলপারি শুরু করি। পরিচিত লেগুনাস্ট্যান্ডের এক লাইনম্যানের মাধ্যমে সাইনবোর্ডে গিয়ে নিজের পরিচয় গোপন রেখে হেলপারি শুরু করি। হেলপারের বেশে ২৪ তারিখ থেকে টানা তিন দিন হত্যাকারীদের খুঁজতে থাকি। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, সাইনবোর্ড, কোনাবাড়ী, ডেমরা, চিটাগাং রোড আর নারায়ণগঞ্জের জালকুড়ি লেগুনাস্ট্যান্ডে হেলপারি করেছি। সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত হেলপারি করে প্রতিদিন ৩০০ টাকা করে পেতাম। হেলপার সেজে ঘুমিয়ে ছিলাম গাড়ির ভেতরেই।’
বিলাল বলেন, ‘লেগুনা রাস্তায় চললে, স্ট্যান্ডে থামলে আমার চোখ খুঁজে বেড়াত লাল রঙের পা-দানির লেগুনাটি। কখনও কখনও স্ট্যান্ডে স্ট্যান্ডে চাকরি খোঁজার নামে খুঁজতাম লেগুনাটি। এভাবে অন্তত ৩০০ লেগুনা যাচাই করেছি। লাল পা-দানির লেগুনা না পেয়ে যাত্রাবাড়ী স্ট্যান্ডে গিয়ে নিজেই লেগুনা চালানোর আগ্রহ প্রকাশ করি অন্য চালকদের কাছে। লাইনে কোনো লেগুনা বসে আছে কি না, তা খুঁজতে থাকি। শেষ পর্যন্ত একজন জানান, একটি লেগুনা নষ্ট হয়ে কদমতলীর একটি গ্যারেজে পড়ে আছে। সেটি মেরামত করে চালানো যাবে। সেটির চালক অসুস্থ হয়ে গ্রামে চলে গেছেন। এরপর কদমতলীর ভুলুর গ্যারেজে গিয়ে পেয়ে যাই লাল পা-দানির সেই লেগুনা।’
এসআই আরও বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছিলাম রহস্য উদঘাটনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। লাল পা-দানির লেগুনা পাওয়ার পর এবার খুঁজতে থাকি লেগুনার মালিককে। পেয়ে যাই তাঁকেও। তাঁর কাছ থেকেই জানতে পারি, এর আগে ফরহাদ নামে এক চালক ছিলেন। ফরহাদ তখন মাদারীপুরে শ্বশুরবাড়িতে। ২৫ জানুয়ারি রাতে টিম নিয়ে চলে যাই মাদারীপুর। সেখানে গিয়ে পেয়ে যাই চালককে। কিন্তু বেঁধে যায় নতুন জট। চালক ফরহাদ তথ্যপ্রমাণ দিয়ে বলতে থাকেন, ২১ জানুয়ারি তিনি লেগুনা জমা দিয়ে শ্বশুরবাড়ি মাদারীপুরে চলে আসেন। প্রযুক্তিগত তদন্তেও তাঁর কথার প্রমাণও মেলে। ফলে হতাশ হয়ে পড়ি। কিন্তু থেমে থাকিনি।’
এসআই আরও বলেন, ‘ফের লেগুনার হেলপার সেজে চলে যাই কদমতলীর ভুলুর গ্যারেজে। জানতে পারি, ২২ জানুয়ারি রাতে লেগুনাটি নিয়েছিলেন মঞ্জুর নামে এক চালক। তাঁর হেলপার ছিলেন আবদুর রহমান। দুজনের নাম জানলেও আর কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। মোবাইল ফোন নম্বর বা বাসার ঠিকানা পাচ্ছিলাম না। গ্যারেজ থেকে বলা হয়, ওই দুজন বিভিন্ন স্ট্যান্ডে আর বিভিন্ন গ্যারেজে থাকেন। কিন্তু দুই-তিন দিন ধরে তাঁদের পাওয়া যাচ্ছে না। এবার রহস্যভেদের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাই। হেলপারের বেশে ও অন্য সহকর্মীদের মাধ্যমে মঞ্জুর ড্রাইভারকে খুঁজতে থাকি। একপর্যায়ে জানতে পারি, মঞ্জুরের হেলপার আবদুর রহমান বাসে হেলপারি শুরু করেছেন। শেষপর্যন্ত তাঁকে পাওয়া গেলেও মিলছিল না মঞ্জুরের খোঁজ। ফলে আবদুর রহমানকে চোখে চোখে রেখে শুরু হয় মঞ্জুরকে খোঁজার কাজ।’
এসআই বিলাল জানান, হঠাৎ একদিন সাইনবোর্ড স্ট্যান্ডে পাওয়া যায় মঞ্জুরকে। তখন গ্রেপ্তার করা হয় মঞ্জুর ও আবদুর রহমানকে। এ দুজনের তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয় রিপন ও রুবেল নামে আরও দুজনকে। আর এর মধ্যমে তাঁর মুক্তি মেলে হেলপারি থেকে।
পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, ‘পরে তারা জানতে পারেন, ফ্লাইওভারে ফেলে দেওয়া সেই ব্যক্তি ছিলেন মাছ বিক্রেতা মহির উদ্দিন। তাকে সাদ্দাম মার্কেট এলাকা থেকে লেগুনায় তোলেন ওই চার হত্যাকারী। এরপর ফ্লাইওভারে নিয়ে তার কাছ থেকে পাঁচ হাজার ৯০০ টাকা ছিনিয়ে নেন। পরে তাঁকে লেগুনা থেকে ফেলা দেওয়া হয়।
এসআই আরও জানান, গ্রেপ্তার হওয়া চারজনই টাকা ছিনতাই এবং ফেলে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আবদুর রহমানের বয়স ১৬ বছর হওয়ায় তাকে কাশিমপুর কারাগারের সংশোধনের জন্য রাখা হয়েছে।