সাগর-রুনি হত্যার এক যুগ, তদন্ত শেষ হবে কবে?
এক, দুই কিংবা পাঁচ বছর নয়, গুনে গুনে আজ ১২ বছর পূর্ণ হলো সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির হত্যাকাণ্ডের। তবে শেষ হয়নি মামলাটির তদন্ত। অথচ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের ধরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এক যুগেও শেষ হয়নি ৪৮ ঘণ্টার সেই প্রতিশ্রুতি। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার কবে শুরু হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে মামলার বাদীর।
সাগর-রুনির সহকর্মীরা প্রতি বছর ১১ ফেব্রুয়ারি রাস্তায় দাঁড়িয়ে এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবি করেন। প্রতি বছরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, এ ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে সংশ্লিষ্টরা। যদিও চলতি বছরের পহেলা ফেব্রুয়ারি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত শেষ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি ৫০ বছর সময় নেয়, তাহলে ততদিন অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
আনিসুল হকের এ বক্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানা স্থানে সমালোচনার ঝড় উঠে। পরে আবার আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তে ৫০ বছর লাগা নিয়ে তার বক্তব্য ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।’ আইনমন্ত্রীর ভাষ্য, সংবাদ সম্মেলনে তিনি আসলে ‘সাগর-রুনি হত্যা মামলার প্রকৃত অপরাধী ধরা না পড়া পর্যন্ত তদন্ত চলবে’ বোঝাতে চেয়েছিলেন। আর সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীকে ধরতে প্রয়োজনে ৫০ বছর লাগার কথাটি তিনি ‘আপেক্ষিক অর্থে’ বলেছিলেন।
আরও পড়ুন : সাগর-রুনি হত্যা : ১০৪ বারেও জমা পড়েনি তদন্ত প্রতিবেদ
১২ বছর পেরিয়ে গেলেও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) তদন্তে থাকা এই জোড়া হত্যার রহস্য উদঘাটনে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বেসরকারি টিভি চ্যানেল মাছরাঙার বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনিকে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে তাদের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে হত্যা করা হয়। হত্যার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের ধরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অথচ এই মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন জমার তারিখ ১০৫ বার পেছানো হয়েছে। চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিলের ধার্য দিন ছিল। কিন্তু র্যাবের পক্ষ থেকে সেদিনও আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি। সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেছেন আদালত।
হত্যাকাণ্ডের পর রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় জোড়া খুনের মামলাটি করেছিলেন রুনির ভাই নওশের আলম রোমান। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘১০৫ বার তদন্ত প্রতিবেদনের সময় পেছাল। এ ঘটনায় আমরা হতাশ। আমরা মনে করি, এ ঘটনায় সরকার বা সরকারের ঊর্ধ্বতন কেউ জড়িত। সেজন্য, এ মামলার তদন্তের কোনো কুলকিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। এক যুগ হয়ে গেলেও প্রাথমিক তদন্তের কাজ শেষ হয় না। কারও ইন্ধন ছাড়া এমনটা হওয়ার কথা নয়। ইদানীং আমার মনে হয়, তদন্ত কর্মকর্তারা হয়তো পুরো ঘটনা জানারও চেষ্টা করেন না। বারবার কেবল তদন্ত কর্মকর্তাই পরিবর্তন হয়, মামলার তদন্তের অগ্রগতি হয় না।’
নওশের আলম রোমান আরও বলেন, ‘সাগর-রুনি ছিলেন সাংবাদিক। এ ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকরাও মাঝেমধ্যে কথা বলেন। বিচার দাবি করেন। কিন্তু, তদন্তের কাজই শেষ হয় না। এমন একটি মামলার ক্ষেত্রে যদি এতো দেরি হয় তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য, তাহলে অন্যদের ক্ষেত্রে কী হওয়ার কথা ভাবেন। আমরা হতাশ হয়ে পড়েছি। র্যাব অনেকের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফরেনসিক সার্ভিসে (আইএফএস) পাঠিয়েছিল। আমি মনে করি এসব স্রেফ সময় নষ্ট করার জন্য করা হয়েছে।’
সাগর-রুনিকে হত্যার সময় ফ্ল্যাটে ছিল এই দম্পতির একমাত্র সন্তান মাহির সরোয়ার মেঘ। তখন মেঘের বয়স ছিল ৫ বছর। এখন মেঘের বয়স ১৭ বছর। রোমান বলেন, মেঘের বয়স এখন ১৭ বছর। এখন সে তার বাবা-মায়ের হত্যার বিষয়ে খুঁটিনাটি জানার চেষ্টা করে। সে বুঝতে চাই, কেন এমনটা হচ্ছে। কেন বিচার পাচ্ছে না। নানা বিষয়ে জানতে চায়।
শেরেবাংলা নগর থানা ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখা মামলাটি সমাধানে ব্যর্থ হওয়ার পর ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল র্যাবকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
হত্যাকাণ্ডের পর রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মাসুম মিন্টু, কামরুল ইসলাম ওরফে অরুণ, আবু সাঈদ, সাগর-রুনির বাড়ির দুই নিরাপত্তারক্ষী পলাশ রুদ্র পাল ও এনায়েত আহমেদ এবং তাদের বন্ধু তানভীর রহমান খানসহ অন্তত ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তানভীর ও পলাশ এখন জামিনে আছেন। বাকিরা কারাগারে।
এ মামলায় রুনির বন্ধু তানভীর রহমানসহ মোট আসামি আটজন। অন্য আসামিরা হলেন- বাড়ির নিরাপত্তারক্ষী এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু ওরফে মাসুম মিন্টু, কামরুল হাসান অরুণ, পলাশ রুদ্র পাল ও আবু সাঈদ। আসামিদের প্রত্যেককে একাধিকবার রিমান্ডে নেওয়া হলেও তাদের কেউই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি।
র্যাব সূত্র জানিয়েছে, ২৫ জনের ডিএনএ নমুনা যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফরেনসিক সার্ভিসে (আইএফএস) পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু, সেখানে পরীক্ষার ফলাফলে নিশ্চিত কিছু পাওয়া যায়নি।
এর আগে, দুটি পৃথক আদালত এ মামলার তদন্ত এবং হত্যার পেছনের রহস্য উদঘাটন করে প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে তদন্তকারীদের ব্যর্থতায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আমরা চেষ্টা করছি মামলাটি সঠিকভাবে তদন্ত করতে। সে কারণে দেরি হচ্ছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে।