পেট চলে না তো কোর্ট-কাচারি করব কীভাবে?
কান্না থামছে না রেনু বিবির। ভুলে গেছেন নাওয়া-খাওয়া। টানা ১০ দিন ধরে অস্থির ছেলের জন্য। যাকে দেখছেন তাকে ধরেই বিলাপ করছেন। হাতে-পায়ে জড়িয়ে ধরে বলছেন, ‘বাবাগো আমার ছেলেডা অসহায়। ও কোনো সাত-পাঁচে নেই। সামান্য চাকরি করত আর অবসরে বাপের সঙ্গে দোকানে চা বিক্রি করত। আমার ছেলেডারে ওরা ধইর্যা নেছে। আমার মানিক তো কোনো অপরাধ করে নাই। ওরে আমার বুকে ফিরায়া দেন।’
থানা থেকে জনে জনে ঘুরে আবার থানা—এভাবেই চক্করে পড়ে বিভিন্ন স্থানে রেনু বিবির এই বিলাপের দৃশ্য নজর কেড়েছে পথ চলতি অনেকের। কিন্তু কে শুনবে তার এই বিলাপ! নিরাপত্তার অজুহাতে বন্ধ ছিল থানার সদর দরজা।
নিজের ‘নিরীহ’ ছেলে মইন উদ্দিন তালুকদার ওরফে আল আমিনের (৩০) পক্ষে কারো কাছে গিয়ে যে দুটি কথা বলবেন সেই পরিস্থিতিও ছিল না তাঁর।
অতঃপর ‘বলির পাঠা’ হিসেবেই ডিবি অফিসে হামলা ভাঙচুর ও পুলিশকে আক্রমণ করার মামলায় আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাঁর নাম।
যে ছেলেকে কেউ কোনো দিন কোনো ঝুট ঝামেলাতেও জড়াতে দেখেনি তাকেই করা হয়েছে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে ভাঙচুর মামলার ২ নম্বর আসামি!
ঢাকা জেলা (উত্তর) গোয়েন্দা কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগে সাভার মডেল থানায় মামলা করেছেন ঢাকা (উত্তর )গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন। গত ২২ জুলাই সাভার মডেল থানায় ৯৯ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেন তিনি।
এই মামলার এজাহার পর্যালোচনা করে দেখা বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরাই মূলত আসামি। সেই তালিকায় মিলেছে আওয়ামী লীগ, কৃষকলীগ এমনকি জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের নামও। ৯৯ জনের দীর্ঘ তালিকার ২ নম্বরে আসামি হিসেবে রয়েছেন মইন উদ্দিন তালুকদার ওরফে আল আমিনের নামও (৩০)।
কেবলমাত্র তারুণ্যের কারণেই নিরীহ আল আমিন আসামির তালিকায় শীর্ষে চলে আসেন এমনটাই বলছেন অনেকে। আরো একটি কারণ গণগ্রেপ্তারে যাদের যেখানে পাওয়া গেছে বাছবিচার ছাড়াই তাদের অনেকেই হয়েছেন অগ্রভাগের আসামি।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় সাভারে পুলিশের ধর পাকড়ের প্রথম দিনেই ২২ জুলাই বিকেলে নিজের অফিসের নিচতলা থেকে মইন উদ্দিন তালুকদার ওরফে আল আমিনকে (৩০) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই স্থান থেকে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন এমন আরও তিনজনকেও আটক করে মামলার আসামি হিসেবে চালান দেয় পুলিশ।
আল আমিনের বাবা লতিফ তালুকদার বলেন, শিমুলতলা চার্চের পাশে মায়েশা ট্রেডিং নামের একটি গার্মেন্টস এক্সেসরিজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে ছোট পদে চাকরি করত আমার ছেলে। মাত্র ১০ হাজার টাকা বেতনে সংসার চলত না। তাই অবসরে শিমুলতায় চায়ের দোকানে বসত সে। আমি চায়ের দোকান চালাই। গত ১০ দিন ধরে সেটাও বন্ধ। কীভাবে ছেলেকে বের করব জানি না। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করি। তিনি ছাড়া আমাদের কেউ নেই। নিজেদের পেট চলে না তো ছেলেকে মুক্ত করতে কোর্ট-কাচারি চালানোর জো নেই—আক্ষেপ করেন লতিফ তালুকদার।
দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে সবার বড় আল আমিন। স্ত্রী ইতি আক্তার। দেড় বছর আগে বিয়ে করেছেন। স্ত্রী, বাবা মা ও বোনকে নিয়ে ছোট সংসার তাঁদের।
আল আমিনের বোন রেখা আক্তার বলেন, ‘আমার ভাইটা এমন নিরীহ যে কেউ তার সঙ্গে অন্যায় করলেও জবাবটা দিতে পারত না। সেই নিরীহ ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে মামলায় চালান দিল! দেশে কি আইন কানুন নাই! সব নিরীহ মানুষ আর কত সইবে!’
আল আমিনকে যে মামলায় চালান দেওয়া হয়েছে–সেই মামলার আসামি হিসেবে আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে ২৪ জন। এদের মধ্যে এজাহারভুক্তই আছেন ১৩ জন। গতকাল সোমবার দুদিনের রিম্যান্ডে নিয়ে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে ডিবিতে।
আল আমিনের মা রেনু বিবি বলেন,‘ছেলের খোঁজের থানায় গিয়েও সাক্ষাৎ পাইনি। পেলে ওসি সাহেবরে হাত-পায়ে ধরে বলতাম, স্যার আমার ছেলে নিরীহ। তদন্ত করে দেখেন। যদি কোনো অপরাধ করে থাকে আমরাই ওকে তুলে দেব। কিন্তু এই আকুতিটুকুও জানাতে পারিনি। ও আল্লাহ আমার পোলাডারে তুমি রক্ষা কর।’
এ ব্যাপারে পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের কাজ আমরা করেছি। কে নিরীহ আর কে অপধারী তা ঘটনার তাৎক্ষণিকতায় বোঝা যাবে না। এটা সত্য এই প্রক্রিয়ায় পড়ে নিরপরাধ অনেকের জীবন বিপন্ন হয়ে যায়। তবে দিন শেষে আল আমিনদের নিজেকেই প্রমাণ করতে হবে যে সে অপরাধ করেনি।’