সংস্কার প্রস্তাব যে কেউ দিতে পারেন, বাস্তবায়ন রাজনৈতিক সরকারের হাতে
বিগত সময়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির তিনবারের সম্পাদক, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিল নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে স্বৈর সরকারের করা মামলাকে লড়তে গিয়ে বেশ কয়েকবার করেছেন কারাবরণ। সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচন করতে গিয়েও হয়েছেন বন্দি। সমসাময়িক নানা বিষয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। উঠে এসেছে সংবিধান, বিচার বিভাগের সংস্কারের বিভিন্ন দিকও। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এনটিভি অনলাইনের স্পেশাল করেসপন্ডেন্টে মো. জাকের হোসেন।
এনটিভি অনলাইন : গত ৫ আগস্টের পর বিচার বিভাগে কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল : এত দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী আমলের পতনের পর আমরা হয়তো একটা প্রত্যাশা করতে পারি। কিন্তু এর বাস্তবায়ন বেশ কঠিন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। বিচার বিভাগও এই চ্যালেঞ্জের বাইরে ছিল না। আমাদের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কাজ করে যাচ্ছেন। এরইমধ্যে উচ্চ আদালতে ২৩ জন বিচারপতির নিয়োগ হয়েছে। তিনজন বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। তারা পদত্যাগ করেছেন। এ ছাড়া সাবেক প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের কয়েকজন বিচারপতি পদত্যাগ করেছেন। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের স্পিরিট অনুযায়ী কয়েকজনকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পক্ষ থেকে তদন্ত চলমান রয়েছে। আমি মনেকরি, অন্তর্বর্তী সরকার অনেক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে।
এনটিভি অনলাইন : বিগত সময়ে সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের বিভিন্ন আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ ছিল। আগামী মার্চে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচন নিয়ে আপনার অভিমত কী?
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল : ফ্যাসিবাদের অন্যতম ন্যারেটিভ ছিল সবাই আমার মানুষ। ভোট লাগবে না। ভোট হলেও কারও ভোট দিতে হবে না। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে দেখা যেত বিএনপির প্রার্থীরা বিজয়ী হতো। সেই কারণে বিভিন্ন আইনজীবী সমিতি নির্বাচনের পরে তারা (আওয়ামী লীগ) দখল করে নিত। আমি গত কয়েক নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভের পরও ৪২ দিন পরে সুপ্রিম কোর্টের কনফারেন্স রুম ভেঙে দখল করে নেয়। যে ব্যক্তিকে সুপ্রিম কোর্টে সবাই তঞ্চক বা তস্কর বলে চেনে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের দিয়ে আইনজীবীদের মারধর করে ফলাফল পরিবর্তন করে দিত। সাংবাদিকেরা নিউজ সংগ্রহ করতে গেলে তাদের পুলিশ দিয়ে পেটানো হতো। একইভাবে ঢাকা বার সমিতি, খুলনা বার সমিতিসহ অসংখ্য আইনজীবী সমিতিতে হামলা করে নির্বাচনি ফলাফল পরিবর্তন করে দেওয়া হতো। ২০২৪ সালে সবচেয়ে বেশি ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। সুপ্রিমকোর্টে আওয়ামী লীগের নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফল আমাদের ভোগ করতে হয়েছে। আমি এর আগে আইনজীবীদের ভোটে দুবার নির্বাচিত হয়েছিলাম। এটা সত্ত্বেও আমাকে মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠিয়ে পাঁচদিন রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করেছে ডিবি। তারা ফ্যাসিবাদী শক্তিকে টিকিয়ে রাখতে মিথ্যা মামলা, নির্যাতন করে সুপ্রিমকোর্টসহ বিভিন্ন বারে শক্তি প্রয়োগ করেছিল। আমি মনেকরি, ভোটের মাধ্যমে এবার মানুষ তাদের প্রার্থীকে জয়ী করবে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে।
এনটিভি অনলাইন : নির্বাচন এলে নীল প্যানেলে বিভাজন দেখা যায়, এতে সাদা প্যানেল সুবিধা পায়। বিভাজন দূর করতে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম কোনো পদক্ষেপ নেবে?
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল : বিএনপি একটি জনবান্ধব এবং জনসমর্থিত রাজনৈতিক দল। এ দলে যে কিছু সুবিধাভোগী থাকবে না, এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। কিছু দুষ্টু প্রকৃতির লোক বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে কাজ করেছে। তারা বিভিন্ন সময়ে কিছু আঞ্চলিক সুযোগ-সুবিধা নেয়, আর্থিক সুযোগ সুবিধা নেয়। আমরা তাদের আইডিন্টিফাই করেছি। আমি যখন আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদের চক্রান্তে কারাগারে, তখন আমাদের মধ্যেও কেউ কেউ আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতায় বসেছে। আবার শেখ হাসিনার আমলে আমাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়েও ক্ষমতায় বসেছে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর অনেকে বড় মুক্তিযোদ্ধা সাজার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে বলে আমি মনে করি।
এনটিভি অনলাইন : সংবিধান সংস্কার করে সংবিধানের তিন মূলনীতির পরিবর্তন ও দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট করার প্রস্তাব এসেছে। এটা কতটুকু যৌক্তিক বলে মনে করেন?
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল : সংস্কার কমিটি যে প্রতিবেদন দিয়েছে সেগুলোর সঙ্গে আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে সংবিধান সংস্কারের জন্য যে ৭৭টি পয়েন্ট দিয়েছিলাম; অনেক পয়েন্টই মিলে গেছে। যেমন—টানা দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয়; রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা; দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট করা—এসবই ছিল বিএনপির সংস্কার প্রস্তাবের অংশ। যদিও মনে রাখতে হবে, এসব প্রস্তাব কিন্তু পাস হতে হবে নির্বাচিত সরকারের সময়ে। এটির বাস্তবায়ন কতটুকু হবে সেটি নির্ভর করবে নির্বাচিত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। পরামর্শ-প্রস্তাব যে কেউ দিতে পারে। সকল প্রস্তাব যে গ্রহণ করতে হবে সেটিও কিন্তু নয়। পরবর্তী পার্লামেন্টে আরও বিজ্ঞ-জ্ঞানী-গুণী মানুষ আসবে, ডিবেট হবে, এরপর এটি পাস হবে।
এনটিভি অনলাইন : বিচার বিভাগের সংস্কার নিয়ে কমিশন কাজ করছে। সেখানে বিচারপতি নিয়োগের নীতিমালা, পৃথক সচিবালয় গঠনসহ কিছু প্রস্তাব এসেছে। বিচার বিভাগ উন্নতির ক্ষেত্রে এগুলো কি যথেষ্ট?
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল : বিচার বিভাগের সংস্কার ইস্যুতে এরইমধ্যে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ পৃথক সংস্কার কমিশন গঠন করে, পৃথক সচিবালয় গঠন এবং বিচারপতি নিয়োগে নীতিমালা শুরুর প্রস্তাব করেছেন। সরকারের বিচার বিভাগের সংস্কার কমিশন প্রস্তাবের পর এ বিষয়ে পরবর্তী সরকার পদক্ষেপ নেবে।
এনটিভি অনলাইন : বার কাউন্সিলের অভিভাবক হিসেবে আইনজীবীদের জন্য আপনার পরিকল্পনা…
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল : ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর আমরা দায়িত্ব নিয়েছে মাত্র অল্প কিছুদিন হলো। আমাদের কাজ হলো নিয়মিত পরীক্ষা গ্রহণ ও দুর্নীতিমুক্তভাবে বার কাউন্সিলকে নেতৃত্ব দেওয়া। সুপ্রিম কোর্ট বারের পরীক্ষায় অনেকে প্রশ্ন তুলেছে, আমরা রিভিউ করার সুযোগ দিয়েছি। আমরা নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে চেষ্টা করব। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলকে সচল করবো। আমাদের সময় আছে মাত্র তিন মাস। আইনজীবীদের কল্যাণে এবং দেশের মানবাধিকারের জন্য আরও কাজ করতে পারব, যদি আমরা সময় বাড়াতে পারি।
এনটিভি অনলাইন : বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সাজা দিয়ে পুরস্কৃত অনেক বিচারপতি বহাল তবিয়তে রয়েছে, আপনারা কোনো পদক্ষেপ নেবেন কিনা ?
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল : আমরা দেশে সুশাসন চাই। যারা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে সাজা দিয়েছে; আমরা মনে করি সম্প্রতি সর্বোচ্চ আদালত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় উল্লেখ করেছে যে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়েছে। আপিল বিভাগের এ পর্যবেক্ষণের পর ওই বিচারকগণ নৈতিকভাবে নিজেরাই বিচারকাজ চালাতে পারে না। আমি মনেকরি, যারা অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত, তারা এ বিচারকাজ চালাতে পারে না।
এনটিভি অনলাইন : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিচারকি আদালত বেগম খালেদা জিয়াকে সাজা দেয়, হাইকোর্ট এটিকে বৃদ্ধি করে। আপিল বিভাগ রায়কে রাজনৈতিক হয়রানি বলে আখ্যা দেয়। বিচার বিভাগের এ পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল : দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের অবিসাংবাদিত নেত্রী। তিনি দেশের এ মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী। তিনি অন্যায়ের কাছে কখনো আপস করেননি। সুস্থভাবে হেঁটে তিনি কারাগারে গেছেন। কিন্তু তাঁকে সুচিকিৎসা দেওয়া হয়নি। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার সঠিক ব্যাখা দেওয়া হয়নি। তাঁকে অন্যায়ভাবে কারাগারে রেখে জীবন বিপন্ন করে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর কাছে হাজার শোকর আদায় করি, তিনি এ মুহূর্তে লন্ডনে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আশা করি, তিনি আমাদের মাঝে পুরোপুরি সুষ্ঠুভাবে ফিরে আসবেন এবং আবার দেশকে নেতৃত্ব দেবেন।
এনটিভি অনলাইন : আইন মন্ত্রণালয় দেশের কোর্ট নিয়ন্ত্রণ করত, রিমান্ডসহ নির্দেশনা আসত, তাদের বিষয়ে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ আছে কিনা?
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল : যারা এসব কাজে জড়িত তারা দেশের মানুষের কাছে চিহ্নিত। যারা এসব গুম-খুন-নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কেন না আমরা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে চাই।
এনটিভি অনলাইন : ৫ আগস্টের পর আদালতে মিথ্যা মামলা দিয়ে বাণিজ্য করছে এবং আইনজীবীদের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আইনজীবীদের নেতা হিসেবে কোনো পদক্ষেপ আছে কিনা ?
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল : একজন আইনজীবী এ ধরনের অনৈতিক কাজ করলে বর্তমান সরকারের উচিত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায়, পুলিশ তাদের, বিচার বিভাগ তাদের, তাই তারা কঠোর পদক্ষেপ নেবে বলে মনে করি। জাতীয়বাদী আইনজীবী ফোরামের পক্ষ থেকে এ ধরনের ঘৃণ্য কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং আমরা সরকারকে সহযোগিতা করব।
এনটিভি অনলাইন : বিচার বিভাগে মামলাজট নিরসনে বারের কর্মপরিকল্পনা…
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল : দেশের মামলাজট নিয়ে আমি প্রচণ্ড হতাশ। এ প্রক্রিয়ায় মামলাজট কমানো কোনোভাবে সম্ভব নয়। কেননা বিএনপির ৬০ লাখ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৪০ লাখ মিথ্যা মামলা করা হয়। আমার বিরুদ্ধে ১১ মামলা। তাই যেখানে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়, সেখানে গোড়াতেই হাত দিতে হবে। নতুন মামলা উদ্ভব হওয়ার আগে সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা সেটি দেখতে হবে। এ ছাড়া দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। গ্রাম্য সালিশ ও বিকল্প বিরোধ করে দেওয়ানি মামলা কমিয়ে আনতে হবে।
এনটিভি অনলাইন : বিচারপ্রার্থী ও বার কাউন্সিল আইনজীবীদের জন্য উদ্দেশে কিছু বলুন…
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল : আমরা আইনজীবী, আমরা সৎভাবে কাজ করে জীবিকা উপার্জন করি। কেউ অন্যায়ভাবে হয়রানি মামলা করলে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কেউ ঢালাওভাবে অভিযোগ করলে হবে না। দেশবাসী ও বিচারপ্রার্থীর উদ্দেশে বলতে চাই, দেশে সুশাসন, ভোটের ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। বিএনপি ক্ষমতায় এলে আমরা দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করব।