যেভাবে ধরা পড়ল রাঙামাটির মোটরসাইকেল ‘চোরচক্র’

কী নেই তাদের কাছে? মোটরসাইকেলের লক কাটার আধুনিক ছুরি থেকে শুরু করে মোটরসাইকেল রং করা, চেসিস ও ইঞ্জিন নম্বর পরিবর্তন করার উপকরণ, বিআরটিএর কাগজপত্র ও নম্বর প্লেট তৈরি করার যাবতীয় সব যন্ত্রাংশ, গাড়ির মালিকানা পরিবর্তনের সব জাল কাগজপত্র।
এভাবেই মানুষের শখের আর প্রয়োজনের মোটরসাইকেল চুরি করে যাচ্ছিল চক্রটি দিনের পর দিন। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ এবং হতাশ ছিলেন পার্বত্য শহর রাঙামাটির মানুষ। ছোট্ট একটি শহর থেকে গত তিন মাসে প্রায় ১৭টি মোটরসাইকেল চুরির ঘটনাকে নজিরবিহীনই বলা যায়। এই মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা নিয়ে বিব্রত ছিল পুলিশও। পুরো পুলিশ বিভাগের সব সাফল্যকেই যেন ম্লান করে দিচ্ছিল মোটরসাইকেল চুরির উপর্যুপরি এই ঘটনা।
অবশেষে একটি ছোট্ট সূত্র ধরেই, মোবাইল ট্র্যাকিং করে প্রায় পুরো মোটরসাইকেল চোর চক্রকে কব্জায় আনল পুলিশ। গত কয়েক দিনে চক্রের একের পর এক সদস্যকে আটকের পর তাদের তথ্যের তথ্যের ভিত্তিতে রোববার রাতে মোটরসাইকেল চুরির কাজে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ যন্ত্রাংশ, পাঁচটি চোরাই মোটরসাইকেলসহ ছয়জনকে আটক করেছে পুলিশ। এ নিয়ে এই ঘটনায় ১১ জনকে আটক করা হলো। সোমবার দুপুরে আটক ব্যক্তিদের কাছ থেকে জব্দ হওয়া জিনিসপত্র সামনে নিয়ে এক অনানুষ্ঠানিক সংবাদ ব্রিফিং করেছেন তাঁরা। টানা এক মাসের চেষ্টায় সাফল্য আসায় খুশিতে উজ্জ্বল জেলার পুরো পুলিশ বিভাগ।
যেভাবে পাওয়া গেল আশার আলো
শহরে একের পর এক মোটরসাইকেল চুরির পরও কোনো কূলকিনারা করতে পারছিল না পুলিশ। এরই মধ্যে শহরের আলম ডক ইয়ার্ড এলাকা থেকে চুরি যায় জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জমীরউদ্দিন ও যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মাহবুব এলাহীর মোটরসাইকেল। এর দুদিন পর সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে কাঁঠালতলী এলাকা থেকে তিন ছাত্রলীগকর্মীকে আটক করে পুলিশ। তাঁদের নিয়ে থানায় যাওয়ার পথে পুলিশের গাড়ি আটক করে তিন আসামিকে ছিনিয়ে নেয় জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুল জব্বার সুজন ও রাঙামাটি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ বাপ্পা। এ নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় তৈরি হলে একজন জনপ্রতিনিধির মধ্যস্থতায় আবার দুই আসামি এরশাদ ও কলিমকে থানায় দিয়ে আসে ছাত্রলীগের নেতারা। পরের দিন কলিমকে জিম্মায় নিলেও এরশাদকে ছাড়তে রাজি হয়নি পুলিশ। এই এরশাদকে রিমান্ডে নিতেই বেরিয়ে আসে একের পর এক তথ্য। খুলে যায় মোটরসাইকেল চুরির হোতাদের গতিবিধি এবং কার্যক্রমের বদ্ধ কপাট। এরশাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে একের পর এক আটক হতে শুরু করে মোটরসাইকেল চুরির সঙ্গে জড়িতরা। পুলিশের অভিযানে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে আটক হয় আলাউদ্দিন, বাদশা, লিটন, শামীম ও শাওন। রিমান্ডে এদের মুখ খুলতে বাধ্য করে পুলিশ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত রোববার রাতে পরিচালিত হয় আসল অভিযান, যার নেতৃত্ব দেন কোতোয়ালি থানা পুলিশের দুই উপপরিদর্শক (এসআই) ইউসুফ চৌধুরী ও সরোজিৎ বড়ুয়া।
যেভাবে অপারেশন
নিজস্ব সোর্স ও গোপন তথ্যের ভিত্তিতে আন্তজেলা মোটরসাইকেল চোর চক্রের সদস্য দীপন ত্রিপুরা দীপুনকে আটক করে পুলিশ। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রামের বায়েজিদ এলাকা থেকে রবিউল হাসান রাকিব ও অং চিং মারমা কালুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই চক্রটিকে গ্রেপ্তারের পর রাঙামাটিতে অবস্থানরত অন্য সদস্যদের বাসায় হানা দেয় পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর রবিউল হাসান রাকিব দুটি মোটরসাইকেল রাঙ্গুনিয়ার জুয়েল ও সোহেলের কাছে বিক্রির তথ্য জানালে সেখানে অভিযান চালিয়ে পাঁচটি চোরাই মোটরসাইকেল, একটি পাঞ্চিং মেশিন, নম্বরপ্লেট খোদাই করার যন্ত্র, ভুয়া ডিজিটাল নম্বরপ্লেট, জাল স্ট্যাম্প, গাড়ি কেনাবেচার ভুয়া রশিদ ও কাগজপত্র, মোটরসাইকেল ভাঙার বিপুল যন্ত্রাংশ উদ্ধার করে এবং রাঙামাটি থেকে বাকি আসামিদের আটক করে। আসামিদের মধ্যে যেমন ক্ষমতাসীন দলের নামধারী কর্মী আছে, তেমনি আছে মোটরসাইকেল শো রুমের ম্যানেজারও।
যারা আটক হলো
মোটরসাইকেল চুরির ঘটনায় এ পর্যন্ত যারা আটক হয়েছে তারা হলো তবলছড়ির কর্মচারী কলোনির আবুল ফজল শামীম (৩৮), ডিসি বাংলো এলাকার মো. আলাউদ্দিন (৩৬), কাঁঠালতলী এলাকার মো. এরশাদ (২৩), ফায়ারসার্ভিস এলাকার তারেক শাওন আমান (২৭), রিজার্ভবাজার মহসিন কলোনির আবদুল মাবুদ (২৯), গর্জনতলী এলাকার অংচি মং মারমা (২৫) ও রিপন ত্রিপুরা দীপ (২৬), দক্ষিণ কালিন্দীপুর এলাকার সুমন চাকমা (২৪), রিজার্ভবাজার মসজিদ কলোনির মো. মনছুর (২৮), আমানতবাগ এলাকার রবিউল হাসান রাকিব (২০) ও মহিলা কলেজ এলাকার হুমায়ুন কবির (২৯)।
থানায় উৎসুক মানুষের ভিড়
এদিকে মোটরসাইকেল চোর চক্র আটক হওয়ার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক থানায় ছুটে যায় কয়েক শ মানুষ। কেউবা নিজের প্রিয় মোটরসাইকেলের সন্ধান পেতে আবার কেউবা নিজের শহরের দুর্ধর্ষ ‘চোরদের’ এক নজর দেখতে ছুটে যায়। এ সময় মোটরসাইকেল ‘চোরদের’ লক্ষ্য করে গালিগালাজও করতে থাকে অনেকেই।
মোটরসাইকেল চুরি যাওয়া সালাউদ্দিন জুয়েল ও রিকো খিসাও এসেছিলেন থানায়। তাঁরা বলেন, নিজের হারিয়ে যাওয়া মোটরসাইকেল উদ্ধার হওয়া মোটরসাইকেলের সঙ্গে মেলে কি না সেটা দেখতেই এসেছেন। না, মিলেনি। তবে তাঁদের আশা, এই চক্র যেহেতু ধরা পড়েছে, সেহেতু এদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে এবং চুরি হওয়া মোটরসাইকেল তারা ফেরত পাবেন।
যা বললেন পুলিশ কর্মকর্তারা
রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মো. শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘একটা মোটরসাইকেলের যত কাজ আছে, খোলা থেকে শুরু করে আবার জোড়া লাগানো কিংবা নম্বর পরিবর্তন বা রং পাল্টানো- সবই এদের কাছে পাওয়া গেছে। এটি একটি সংঘবদ্ধ মোটরসাইকেল চোরচক্র। এদের পেছনে আমরা বেশ কিছুদিন ধরে লেগেছিলাম, প্রযুক্তি ব্যবহার করেই এদের আটক করতে সক্ষম হয়েছি আমরা।’
রাঙামাটির সহকারী পুলিশ সুপার চিত্তরঞ্জন পাল বলেন, “এ যেন মোটরসাইকেলের ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’। কী নেই এদের কাছে! আশ্চর্য হয়েছি আমরা। রাঙামাটির মতো ছোট্ট একটি শহরে এমন দুর্ধর্ষ অপরাধী চক্র সত্যিই ভাবনার বিষয়।”
রাঙামাটির পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান বলেন, ‘আমরা এই চক্রের বড় একটি অংশকেই ধরতে সক্ষম হয়েছি। আশা করছি বাকি যারা আছে তারাও পার পাবে না। আমরা এদের কাউকেই ছাড়ব না। আশা করছি, এবার এ শহরে মোটরসাইকেল চুরি চিরতরে বন্ধ হবে।’