‘সাংবাদিক’ ঠেকাতে নিজেই সাংবাদিক হলেন শিক্ষক!
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2017/09/16/photo-1505574244.jpg)
এ এন এম আহছানুল হক। রাজধানীর দক্ষিণ খান এলাকার একটি স্কুলের পরিচালক তিনি। এ ছাড়া সরদার সুরুজ্জামান মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপকও আহছানুল হক। নিজের প্রচেষ্টায় তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন আনমাহ ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি স্কুল। নিজে অন্য কলেজে চাকরি করার কারণে স্ত্রীকে বানিয়েছেন ওই স্কুলের অধ্যক্ষ। শতাধিক শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়ে বেশ সুনামের সঙ্গেই চলছিল তাঁর স্কুলটি। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন স্কুলে হাজির হলেন এক কথিত সাংবাদিক। এরপর ঘটল অন্যরকম ঘটনা।
হাজির হয়েই প্রথমে স্কুলের কাগজপত্র দেখতে চান ওই সাংবাদিক। এরপর হুমকি দিয়ে বলেন, ‘আমি চাইলে একদিনের মধ্যে আপনার স্কুলের সাইনবোর্ড নামিয়ে দিতে পারি। কিন্তু আমি তা করব না, আমি আপনার স্কুলের পক্ষেই নিউজ করব। আপনি শুধু আমাদের একটু সহযোগিতা কইরেন।’
এ ঘটনার কিছুদিন পরই আনমাহ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হয়। অনুমতি না নিয়েই সেই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ছবি পত্রিকায় ছাপিয়ে ছয় হাজার টাকার বিল নিয়ে অফিসে হাজির হন ওই সাংবাদিক। চাপ দিতে থাকেন টাকার জন্য। উপায়ন্তর না দেখে টাকা দিয়েও দেন শিক্ষক আহছানুল হক। কিন্তু এর পরও নানাভাবে স্কুলের বিরুদ্ধে নিউজ করার ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি করেন ওই সাংবাদিক। আর তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন ওই এলাকার আরো কয়েকজন সাংবাদিক।
সাংবাদিকদের এমন কাণ্ডের পর শিক্ষক আহছানুল হকও সিদ্ধান্ত নেন তিনি ‘দৈনিক আজকের আলোকিত সকাল’ পত্রিকার একজন প্রতিনিধি হবেন। তাহলে আর কেউ তাঁকে বিরক্ত করবে না। এ জন্য ওই পত্রিকা অফিসে গিয়ে তিনি সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলেন। সম্পাদক তাঁকে জানান তিনি ওই পত্রিকার প্রতিনিধি হয়ে গেলে সেখানকার কোনো সাংবাদিক আর তাঁকে বিরক্ত করবে না। এরপর সম্পাদকের কথামতো তিনি পাঁচ হাজার টাকায় ওই পত্রিকার একটি পরিচয়পত্র নেন। কিন্তু নিজে সাংবাদিক হওয়ার পরেও ওই সাংবাদিকদের হয়রানির হাত থেকে রেহাই পাননি তিনি। অবশেষে তাঁদের নামে দক্ষিণখান থানায় তিনটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন আহছানুল হক।
এ বিষয়ে কথা হলে এ এন এম আহছানুল হক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘হাসান নামের এক ব্যক্তি এসে সাংবাদিক পরিচয় দেন। গত ডিসেম্বর মাস থেকে তিনি স্কুলে এসে নানা রকম কাগজপত্র দেখতে চান। পরে বলেন যে আমি তো কোনো নিউজ করলে আপনার ব্যানারই থাকবে না। আমরা পেপারে আপনার পক্ষেই নিউজ দেব, কিন্তু আমাদের কিছু টাকা-পয়সা দরকার। এই বলে চলে যান। এরপর নানা রকম বিজ্ঞাপন নিয়ে এসে টাকা দাবি করেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে অসুস্থতার কারণে তেমন কোনো প্রতিবাদ করতে পারি নাই। কিন্তু এভাবেই তিন-চার মাস চলে যায়।’
যেভাবে হলেন ‘সাংবাদিক’
সাংবাদিক হওয়ার বিষয়ে শিক্ষক আহছানুল হক বলেন, ‘কিছু দিন পর দেখলাম ওই পত্রিকায় সাংবাদিক নিয়োগ ও বিজ্ঞাপন দাতা নিয়োগ করা হবে। আর সেখানে সরাসরি সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ করার ঠিকানাও দেওয়া আছে। এরপর ভাবলাম অফিস যেহেতু উত্তরাতেই, যাই একটু ঘুরে আসি। ভেবেছি আমি পত্রিকার প্রতিনিধি হয়ে যাই, তবে এর পর থেকে কোনো প্রতিনিধি আমাকে বিরক্ত করবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমি সম্পাদকের কাছে বললাম, আমার তো প্রতিষ্ঠান আছে অনেকে বিরক্ত করে। তখন তিনি (সম্পাদক) বললেন, আমিও আগে এই রকম প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম। অনেক সাংবাদিক আমাকে বিরক্ত করত। তারপর আমি সম্পাদক হওয়ার পরে এখন কেউ আমাকে বিরক্ত করে না। মূলত আমারও ইচ্ছা ছিল যে আমি একজন সাংবাদিক হব, সাংবাদিক হলে এখানে অবৈধভাবে কেউ আসতে পারবে না।’
আহছানুল হক আরো বলেন,‘এরপর যে ছেলেটা আমাকে বিরক্ত করে, হাসান। সে (হাসান) নিজে বলে আমরা সাংবাদিক ছাড়া কাউকেই ভয় করি না। রাজনৈতিক কোনো নেতা বা অন্য কাউকেই ভয় করে না। গত ঈদের আগে আমি ট্রেনে যখন বাড়ি যাচ্ছিলাম, তখন হাসান ফোন করে বলেছে, আমাকে ঈদ বোনাস দিতে হবে। আমি যখন বলেছি ঈদ বোনাস দিতে পারব না, তখন সে বলে আমি ব্যবস্থা নেব আপনার বিরুদ্ধে। আমি বললাম কী ব্যবস্থা নেবেন? তখন সে বলে আমি লিখব আপনার বিরুদ্ধে। আমি বললাম লিখেন যত পারেন, আমি কোনো টাকা দিতে পারব না। এরপর সে আমার এবং আমার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নানা রকম মিথ্যা নিউজ লিখল। এরপর আমি থানায় জিডি করেছি তাঁর বিরুদ্ধে।’
আহছানুল হক বলেন, ‘এরপরও ওই সাংবাদিক ফেসবুকে আমার ছবি ব্যবহার করে আপত্তিকর কথা লিখেছে। তখন আমি ডিএমপিতে ফোন দিলাম, কী করতে পারি জানতে। ডিএমপি থেকে আমাকে বলা হলো আপনি স্থানীয় থানায় জিডি করেন। এরপর জিডির কপি নিয়ে সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কাছে চলে আসেন।’
আহছানুল হক এনটিভি অনলাইনকে আরো বলেন, ‘জিডি করার পর যখন আমি সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কাছে মামলার জন্য গিয়েছি, তখন সাংবাদিক মাহমুদুল হাসান নামের এক কথিত সাংবাদিক এই বিষয়টা মিটমাট করার জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু আমি মিটমাট করতে যাব কেন, আমি তো কোনো অন্যায় করি নাই। বর্তমানে এই ঘটনার কারণে প্রতিষ্ঠানের পাঠদানে অনেক সমস্যা হচ্ছে। আমরা অনেক বেশি হয়রানি হচ্ছি।’
জানতে চাইলে সাংবাদিক মো. হাসান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমার নামে দক্ষিণখান থানায় চারটা জিডি করেছেন তিনি (আহছানুল হক)। আমি যে তাঁর কাছে কোনো টাকা চাইছি, এ রকম কোনো ডকুমেন্ট আছে কি তাঁর কাছে? তিনি প্রায়ই আমাকে ফোন দেন, ভাই একটু আইসেন চা-টা খেয়ে যাইয়েন। আমি তো বেআইনিভাবে টাকা নেব না। আর আমি চাইলেই তিনি দেবেন কেন? অনেক সময় তিনি আমাদের ডেকে বলেছেন, ভাই বিজ্ঞাপনটা দিয়ে দিয়েন। আমি দিয়েছি, তিনি টাকা দিয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমি যে তাঁর পেছনে লেগে আছি, এমন কিছু না ভাই। তিনি আমাকে অনেক ধরনের লোক দিয়ে নানা রকমের হুমকি দিচ্ছেন। সে কারণে আমি উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি জিডি করেছি। থানা থেকে তাঁকে কয়েকবার ডেকেছে, কিন্তু তিনি আসেন নাই।’
এ এন এম আহছানুল হকের নামে অভিযোগ করে সাংবাদিক হাসান আরো বলেন, এক নারীকে তিনি কুপ্রস্তাব দিয়েছেন। এরপর সেই নারী থানায় গিয়ে মৌখিকভাবে অভিযোগ দিয়েছেন। সব কিছু জানার পরও এখনো এই বিষয় নিয়ে তিনি কোনো নিউজ করেন নাই বলে দাবি করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দক্ষিণখান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, সাংবাদিক হাসানের নামে আহছানুল হকের দায়ের করা অভিযোগের তিনি তদন্ত করছেন। এখনো তদন্তকাজ শেষ হয়নি। আর ফেসবুকের পোস্ট নিয়ে তাঁর যে অভিযোগ রয়েছে, সেটা ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিট দেখছে।