রাবির সাবেক উপাচার্য ও তাঁর পরিবারের সম্পদের খোঁজে এনবিআর
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মেয়াদের শেষ দিন শতাধিক নিয়োগ দিয়ে বিতর্কিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এসব নিয়োগে বিপুল পরিমাণ আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে অধ্যাপক আবদুস সোবহান ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে। এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল সম্প্রতি বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে চিঠি দিয়ে আবদুস সোবহান, তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা সোবহান, ছেলে মুশফিক সোবহান, মেয়ে সানজানা সোবহান ও জামাতা এ টি এম শাহেদ পারভেজের ব্যাংক হিসাব চেয়েছে।
এদিকে, তিন সপ্তাহ ধরে উপাচার্য পদটি ফাঁকা থাকায় ব্যাহত হচ্ছে রাবির প্রশাসনিক কার্যক্রম। তাই দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে একজন সৎ ও যোগ্য উপাচার্য নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এরই মধ্যে উপাচার্য হতে লবিং শুরু করেছেন একাধিক শিক্ষক। এ ছাড়া সৎ ও যোগ্য বিবেচনায় শোনা যাচ্ছে আরও কয়েকজনের নাম। এই মুহূর্তে উপাচার্য পদে যাঁদের নাম সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান, অধ্যাপক রকীব আহমেদ, অধ্যাপক জিনাত আরা, অধ্যাপক মো. হাবিবুর রহমান, অধ্যাপক মো. আবুল কাশেম, অধ্যাপক সফিকুন্নবী সামাদী, অধ্যাপক এম শহীদুল্লাহ ও বর্তমান উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা। তবে বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান তাঁর মেয়াদের শেষ দিনের নিয়োগ, যা এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অবৈধ ঘোষণা করেছে, সেসব নিয়োগ বহাল রাখার পাশাপাশি তাঁর মেয়াদকালের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না, এমন একজনকে উপাচার্য পদে নিয়োগ দিতে নানা মহলে লবিং করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেনের কথাও শোনা যাচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করেছেন। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে আইন ও বিধিবদ্ধ প্রথা ভেঙেছেন। সবশেষ তিনি উপাচার্য হিসেবে মেয়াদের শেষ কর্মদিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে ১৩৮ জনকে এডহকে একযোগে নিয়োগ দিয়ে সমালোচিত হয়েছেন। এ ঘটনা তদন্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিসির বিদেশ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির সুপারিশ করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, বিপুল অর্থের বিনিময়ে মেয়াদের শেষ দিন গত ৬ মে ১৩৮ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন আবদুস সোবহান। এর আগেও তিনি নীতিমালা শিথিল করে অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে নিজের মেয়ে ও জামাতাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পরিবর্তন করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগের তদন্ত করে প্রমাণও পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ মেলার পর অধ্যাপক আবদুস সোবহান ও তাঁর পরিবারের পাঁচ সদস্যের সম্পদের খোঁজে নেমেছে এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল। দেশের সব ব্যাংকের কাছে পাঠানো এনবিআরের চিঠিতে অধ্যাপক আবদুস সোবহান ও তাঁর পরিবারের পাঁচ সদস্যের একক বা যৌথ নামে অথবা তাঁদের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক আমানত, যে কোনো স্থায়ী, চলতি ও ঋণ হিসাব, ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্ট, ক্রেডিট কার্ড, সঞ্চয়পত্র বা অন্য যে কোনো ধরনের সঞ্চয় থাকলে আগামী ১ জুনের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ এর ১১৩ (এ) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ তথ্য চাওয়া হয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে রাবিতে নিজের পক্ষের একজনকে উপাচার্য বানাতে নানা মহলে লবিং শুরু করেছেন সাবেক উপাচার্য এম আবদুস সোবহান। বিদায়ী উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নিজের পছন্দের একজনকে উপাচার্য পদে বসাতে মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের জন্যেও প্রস্তুত রয়েছেন বিদায়ী উপাচার্য। এ ক্ষেত্রে তাঁর পছন্দের আলিকায় রয়েছেন ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অবসর পরবর্তী ছুটিতে (পিআরএল) থাকা অধ্যাপক রকীব আহমেদ এবং ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এম শহীদুল্লাহ। ক্যাম্পাসের একাধিক সূত্র জানায়, বিদায়ী উপাচার্য আবদুস সোবহানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত অধ্যাপক রকীব আহমেদ আগামী ৩০ জুন পুরোপুরি অবসরে যাবেন। আবদুস সোবহান উপাচার্য পদে তাঁর প্রথম মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক করেছিলেন রকীব আহমেদকে। ওই সময় আরও বেশ কয়েকটি দায়িত্বে তাঁকে রেখেছিলেন তিনি। তবে অধ্যাপক রকীব আহমেদের ওপর বিক্ষুব্ধ রয়েছেন রাবির মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ। কারণ হিসেবে সরকারপন্থি শিক্ষকদের এই সংগঠনের নেতারা জানান, ওয়ান ইলেভেনের সময় যখন দেশ উত্তাল, তখন দেশ ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন অধ্যাপক রকীব আহমেদ। সেখানে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দি ইসলামিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাহায়ালপুরের ভূগোল বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ ছাড়া তাঁর এক ভাই রাজশাহী কলেজে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। ব্যাংকে চাকরি করা তাঁর আরেক ভাইয়ের বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।
সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এম শহীদুল্লাহ রাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন। উপাচার্য এম আবদুস সোবহানের সময় তিনি ইনস্টিটিউট অব ইংলিশ অ্যান্ড আদার ল্যাংগুয়েজেজ-এর পরিচালকের দায়িত্ব পান। এখনও সেই দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। এ ছাড়া আবদুস সোবহানের প্রথম মেয়াদে তিনি ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (আইবিএস)-এর পরিচালক ছিলেন।
এদিকে, রাবির উপাচার্য পদে আরও যাঁদের নাম বেশি আলোচিত হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক জিনাত আরা ব্যবস্থাপনা বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ডিন ছিলেন। জিনাত আরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। বিদায়ী উপাচার্য এম আবদুস সোবহানের অনিয়মের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে তাঁকে সোচ্চার থাকতে দেখা গেছে।
ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান ২০১৩-২০১৭ মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। রাবির সম্ভাব্য উপাচার্য হিসেবে তাঁর নাম শোনা যাচ্ছে। চৌধুরী সারওয়ার জাহান বিশ্ববিদ্যালয়ের জীব ও ভূবিজ্ঞান অনুষদের ডিন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা এবং ভূতত্ত্ব ও খনি বিভাগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন প্রায় ৩৪ বছর ধরে। তিনি দেশের পানি কমিশনের সদস্য। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর গত বছর পর্যন্ত ৫০ জন বিজ্ঞানীর তালিকা করা হয়, সেখানে তাঁর নাম উঠে এসেছে ৪৩ নম্বরে।
প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. হাবিবুর রহমানের নামও শোনা হচ্ছে সম্ভাব্য উপাচার্য হিসেবে। বর্তমানে তিনি রাবির মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের আহ্বায়ক। বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহানের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন তিনি।
রাবির সম্ভাব্য উপাচার্য হিসেবে আরও যাঁদের নাম শোনা যাচ্ছে, তাঁদের মধ্যে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মো. আবুল কাশেম রাজশাহী জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক। বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সফিকুন্নবী সামাদী সদ্য বিদায়ী উপাচার্যের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
এ ছাড়া উপাচার্য হওয়ার দৌড়ে আরও রয়েছেন বর্তমান উপ-উপাচার্য অধ্যাপত আনন্দ কুমার সাহা, ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক এবং হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থা বিভাগের অধ্যাপক সাইয়েদুজ্জামান মিলন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বলেন, সদ্য সাবেক উপাচার্য এম আবদুস সোবহন পুলিশের পাহারায় ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। এখনও তিনি পুলিশের পাহারায় রয়েছেন। একজন অধ্যাপকের জন্য এর চেয়ে আর ‘নিষ্ঠুর নিয়তি’ কী হতে পারে। তিনি যেন দেশত্যাগ করতে না পারেন, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে ইউজিসি।
রাবির প্রগতিশীল কয়েকজন শিক্ষক জানান, এবার উপাচার্য হিসেবে যিনি নিয়োগ পাবেন, তাঁর জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। যদি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নষ্ট হয়ে যাওয়া সম্মান’ কিছুটা হলেও উত্তরণ করতে চান, তাহলে তাঁকে সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতেই হবে। না হলে এম আবদুস সোবহানের চেয়েও খারাপ অবস্থা নিয়ে তাঁকে চার বছর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় নিতে হবে। তাঁরা আরও বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতিতে এমন একজন উপাচার্য প্রয়োজন, যিনি সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারবেন। স্থানীয় রাজনীতি থেকে ক্যাম্পাসকে বাইরে রাখতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা রক্ষায় যিনি সব চাপ উপেক্ষা করতে পারবেন।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্তত চার-পাঁচ বছর পর অবসরে যাবেন, এমন কাওকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। কেননা অধ্যাপক এম আবদুস সোবহানের চাকরির মেয়াদ থাকলে তিনি শেষ কর্মদিবসে গণহারে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়ে যেতে পারতেন না। শুধু তাই নয়, তিনি একের পর এক অনিয়ম করেছেন শুধু পিছুটান নেই বলে। তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ফিরে আসতে হবে না বলেই তিনি কাউকে পরোয়া না করে অনিয়ম করেই গেছেন। তাই নতুন উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি সরকারকে অবশ্যই ভাবতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি দায়বদ্ধতা নেই, এমন কাউকে উপাচার্য করা মোটেও যুক্তিযুক্ত হবে না।