ছোঁয়াচ দলে ফিরল আবার কোলাকুলির দিন
শিকড়ে ফেরার টান মানুষকে দুর্নিবার করে তোলে। ব্যাকুল হৃদয় আনচান করে ওঠে। কর্মের যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষের মন উড়ালপাখি হতে চায়।
সময়ের নদীতে ময়ুরপঙ্খী এক নাও ভাসিয়ে প্রাণ যেতে চায় জন্মভিটার সুখাশ্রমে। আসলে রাজধানীর জৌলুস নয়, সারা বেলাই মনটা পড়ে থাকে গ্রামীণ মায়ের আঁচলতলে। মায়ের গায়ের ঘ্রাণ শুঁকবার অলৌকিক আনন্দটাকে নিবিড় করে পেতে বছরশেষে ঈদটাই হয় এক অনন্য অনুষঙ্গ। সেই অপার্থিব অপার আনন্দের প্রকরণে বাধা হতে পারে না সড়কপথের ভোগান্তি, ফেরিঘাটের দীর্ঘতর অপেক্ষা, বিলম্বিত ট্রেনের ছাদে বৈশাখের খরতাপ, লঞ্চের ধকল কিংবা ট্রাক-ভ্যানের ধুলোয় মাখামাখি।
এবার রংবেরঙের ফুল ও বাহারি ফলের মাস বৈশাখে পড়েছে প্রাণের ঈদ। শহুরে যে বালকটি জাতীয় বৃক্ষে কাঁচা আম ঝুলে থাকতে দেখে না, ঈষাণ কোণে কালবোশেখির কালো মেঘের ভয়ঙ্কর রূপ দেখে না, যাদের উঁচু উঁচু রঙিন দালানের ভিতর দিয়ে শত কিলোমিটার বেগে ঝড়ো হাওয়া বয় না, ঘাসের ডগায় উন্মাতাল বৃষ্টির উদ্দাম নাচন চোখে পড়ে না; সেই বালক-বালিকার কাছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গীতাঞ্জলি কোনো দ্যোতনা জাগায় না—
ঝড় এলো এলো ঝড়
আম পড় আম পড়
কাঁচা আম ডাঁশা আম
টক টক মিষ্টি
এই যা—
এলো বুঝি বৃষ্টি।
কিন্তু সব ধকল জলাঞ্জলি দিয়ে নাড়ির টানে যে মানুষটি তাঁর নীড়ে ফিরলেন, তাঁর উত্তরপ্রজন্ম নিশ্চয়ই বৈশাখের রুদ্ররূপকে বুঝে নেবে। ঝোপঝাড়ে ঘেরা মাটির সড়কের পাশ দিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা আম্রশাখের কাঁচা আমে মুগ্ধ হবে। ভাগ্যসংহিতা সহায় হলে মিলে যেতে পারে রসনাতৃপ্তকর পাকা আমের অমৃত আস্বাদটাও। পথে যেতে যেতে সোনার বরণ পাকা ধানের হাতছানিতেও নিশ্চয়ই মুগ্ধ হবে নবীন প্রাণ।
আজকের ঈদটাই হতে পারে আপন আলয়ে তীর্থগামী কোনো এক নব পরীণিতার যুগলবন্দিতার সুশোভন সাক্ষী। মুক্তির আশে জীবনটাই আহুতি দেওয়ার সংকল্প দৃঢ়তা পেতে পারে। কত মানুষের মেলবন্ধনে মিলতে পারে চিরকাঙ্ক্ষিত হিতবাদিতা। বৃষ্টি নিংড়ে নামা নতুন জলসিঞ্চিত পুকুরপাড়ে ঘাসের গালিচায় বসে বিচিত্র প্রজাপতির আতিথ্যে চলতে পারে অনিন্দ্য সুখবিলাস। সর্বজনের মনের মাঝে মুক্তি খুঁজতে খুঁজতে তুচ্ছ হতে পারে সকল দুঃখবিপদ। দেহমনের সুদূর পারে আপনারে হারিয়ে ফেলা সেই মাহেন্দ্রক্ষণটা উপভোগ্য করতে কবিগুরু এসেও গলা খুলতে পারেন—
কথা ছিল এক-তরীতে কেবল তুমি আমি
যাব অকারণে ভেসে কেবল ভেসে,
ত্রিভুবনে জানবে না কেউ আমরা তীর্থগামী
কোথায় যেতেছি কোন দেশে সে কোন দেশে।
আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,
আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে।
পৌনে দুই কোটি নাগরিকের অস্থায়ী আবাস রাজধানী ছেড়ে এলো কোটি মানুষ। অনিচ্ছার কাঁধে বয়ে বেড়ানো জীবন ও জীবিকার ওজনদার জোয়াল নামিয়ে রেখে যে আনন্দের আতিশয্যটা বাড়ি ফিরে এলো সেই আসাতেই যেন তাঁর মহান মুক্তি। ঢাকার বায়ুদূষণের জায়গায় শস্যের গন্ধ মেশানো গ্রাম্য হাওয়ার পবিত্র পরশ, বিকট শব্দদূষণের পরিবর্তে পাখপাখালির স্বর্গীয় কূজন, গরমের অস্বস্তিকে ঢেকে যায় মেঘের শীতল। কি শ্রমজীবী, কি আধিকারিক, কি মজুর, কি সাহেব—সবার ঐকতানেই জমে গেল সর্বমানুষের মিলনমেলা।
ভয়ঙ্কর কোভিডের অশুভ ছোঁয়াচ পায়ে দলে আবার গলাগলি ও কোলাকুলির দিন ফিরে এলো। মানুষে মানুষে সহমর্মিতা ও ভালোবাসবার রেওয়াজটারও মানভঞ্জন ঘটল।
কবি কামিনী রায় তাঁর সেই অমোঘ কবিতাখানিই যেন বারবার শুনিয়ে যাচ্ছেন—
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী ’পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।
কবির এমন চিন্তা ও দর্শনের মহান ব্রতই আমাদের আজকের ঈদ উৎসবের প্রধান অতিথি। আমরা মায়া ও মমতা দিয়ে সেই অতিথির জন্য বরণডালা সাজাব। সেমাই, ফিরনি, পায়েস বা মিষ্টান্ন থাকুক আপ্যায়নে। সহাস্য, সত্য ও সুন্দর অনুভূতিরা প্রাণের উৎসবে রং ছড়াক। ঔদার্য ও সহিষ্ণুতা থাক তাদের সঙ্গী-সারথি হয়ে। দেশপ্রেমকে আজ ডাক দিয়ে আবার বলব, ওগো দেশমাতা আমি তোমায় ভালোবাসি, মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি। কে ভালো কে মন্দ, কে স্বধর্মী কে নিধর্মী—এই ভেদবিচার আজ দূরে থাক। মানুষের বন্দনা হোক ঈদুল ফিতরের মূলমন্ত্র।
তবেই না দ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম এসে ভরাট গলায় তাঁর চিরায়ত গানটি শুনিয়ে যাবেন—
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
লেখক : সাংবাদিক