বঙ্গমাতার জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয় সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৯২তম শুভ জন্মদিনে তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। জাতির পিতার নাম স্বদেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী পরম শ্রদ্ধায় উচ্চারিত হওয়ার নেপথ্যে ছিলেন তাঁর প্রিয় সহধর্মিণী। আমৃত্যু নেপথ্যে থেকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পরম মমতায় বঙ্গবন্ধুকে আগলে রেখেছিলেন এই মহীয়সী নারী। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলোতে বাস্তবোচিত ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত দিয়ে তিনি বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ায় অনন্য ও ঐতিহাসিক অবদান রেখেছেন।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জন্মগ্রহণ করেন। আজ তিনি বেঁচে থাকলে বয়স হতো ৯২ বছর। বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনের ১২টি বছর বঙ্গমাতা অপরিসীম দুঃখ-কষ্টে সংসারজীবন অতিবাহিত করেছেন। ’৫৪-তে তিনি ঢাকায় আসেন এবং গেন্ডারিয়ায় রজনী চৌধুরী লেনে বাসা ভাড়া নেন। ’৫৪-তে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হলে বঙ্গবন্ধু বন ও কৃষি মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তখন গেন্ডারিয়ার বাসা ছেড়ে ৩ নম্বর মিন্টু রোডের সরকারি বাড়িতে ওঠেন। অল্প দিনের মধ্যেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ৯২-ক ধারা জারি করে মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয় এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। মাত্র দুই সপ্তাহের নোটিশে বঙ্গমাতাকে বাসা খুঁজতে হয় ও নাজিরা বাজারে বাসা নেন। ’৫৫-তে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন ও একই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারে শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও গ্রাম প্রতিরক্ষা দপ্তরের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু পরিবার ১৫ আবদুল গণি রোডের বাসায় ছিলেন। কিছুদিন পর মন্ত্রিত্ব অথবা দলের দায়িত্ব গ্রহণের প্রশ্ন সামনে এলে বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছায় মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করে দলীয় সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বঙ্গমাতাকে বাসা বদল করতে হয়। এবার বাসা নেন সেগুনবাগিচায়। এ সময় বঙ্গবন্ধু টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হন। ’৫৮-এর ৭ অক্টোবর আইয়ুবের সামরিক শাসন জারি হলে ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এবারও বঙ্গমাতা পরিবার-পরিজন নিয়ে অসহায় অবস্থায় বাসা খুঁজতে থাকেন এবং সেগুনবাগিচায় নির্মাণাধীন একটি বাড়িতে বাসা নেন। পরে সেটি পাল্টে ৭৬ সেগুনবাগিচায় অপর একটি বাড়ির দোতলায় ওঠেন। তখন বঙ্গবন্ধুর নামে ১৪টি মামলা। ’৬১-তে বঙ্গবন্ধু কারামুক্ত হয়ে আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি নেন। বঙ্গবন্ধু পরিবার ’৬১-এর ১ অক্টোবর ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেন। এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি হয়ে ওঠে বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ঠিকানা। বঙ্গবন্ধু দলীয় নেতাকর্মীদের প্রত্যেককে দেখতেন নিজ পরিবারের সদস্যের মতো। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যগণও তা-ই মনে করতেন। নেতাকর্মীদের বিপদ-আপদে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা তাঁদের পাশে দাঁড়াতেন পরমহিতৈষীর মতো। মমতা-মাখানো সাংগঠনিক প্রয়াস নিয়ে কর্মীদের হৃদয় জয় করে নেওয়ার ব্যতিক্রমী যে ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুর ছিল, সেই চেতনার আলোয় আলোকিত ছিলেন বঙ্গমাতা।
স্মৃতির পাতায় সযতনে সঞ্চিত কিছু ঘটনা আজও আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। ’৬৯-এর গণআন্দোলনে বঙ্গমাতার অবদান সব সময় কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি। একটা সময় ছাত্রলীগ এবং আমাদের খুব কঠিন অবস্থা গেছে। এমন দিনও গেছে আমরা ছাত্রলীগের অফিস ভাড়া দিতে পারিনি। ১৯৬৬-৬৭ সালের একটি ঘটনা মনে পড়ে। শ্রদ্ধেয় নেতা প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক তখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, জনাব মজহারুল হক বাকী সভাপতি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকবাল হলের (শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ভিপি। আমি মোটরসাইকেল চালাচ্ছি, রাজ্জাক ভাই পেছনে বসা। গন্তব্য আগামাসি লেনে অবস্থিত ছাত্রলীগের অফিস। সেখানে যাওয়ার পর বাড়িওয়ালা আমাদের ডেকে বললেন, ‘আপনারা এখান থেকে চলে যান। তিন মাসের ভাড়া বকেয়া। আপনারা অফিস ভাড়া দিতে পারেন না। এখানে ছাত্রলীগ অফিস রাখা যাবে না।’ আমরা বাড়িওয়ালাকে সবিনয়ে অনুরোধ করলাম দয়া করে আমাদের কয়েক ঘণ্টা সময় দিন। তিনি আমাদের অনুরোধ রাখলেন। তখন বঙ্গবন্ধুসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধ। আমরা সেখান থেকে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গমাতার কাছে গিয়ে আমাদের দুরবস্থার কথা বললে তিনি রাজ্জাক ভাইয়ের হাতে ২০০ টাকা দিলেন। এই ২০০ টাকা থেকে বাড়িওয়ালার তিন মাসের ভাড়া বাবদ মাসিক ৬০ টাকা করে ১৮০ টাকা পরিশোধ করলাম। বাকি ২০ টাকা দিয়ে আমরা একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেলাম। যখন গণআন্দোলন শুরু হয় তখন তিনি নিজে, আজ আমাদের যিনি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সাথে ইকবাল হলের; ইকবাল হল ছিল আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু; সন্নিকটে শিক্ষকদের যে আবাসিক এলাকা, সেখানে গাড়িতে বসে থাকতেন। আমাদের ডেকে আর্থিক সাহায্য এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে ওনার দেখা হতো, বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে প্রাপ্ত দিকনির্দেশনা আমাদের বুঝিয়ে বলতেন। খুব কঠিন সময়ে তিনি ছাত্রলীগও পরিচালনা করেছেন।
১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ’৬৯-এর গণআন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। সেদিন ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি তথা ডাক-এর মিটিং ছিল পল্টন ময়দানে। ওই দিন বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যেখানে বঙ্গবন্ধুর বিচারকার্য চলছিল, সেখানে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। গাড়ি চালিয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রয়াত স্বামী শ্রদ্ধেয় ডক্টর ওয়াজেদ মিয়া। বঙ্গবন্ধু আমাকে বুকে টেনে আদর করে বলেছিলেন, ‘আজ তুই পল্টনে বক্তৃতা করিস।’ আমি বলেছিলাম, আমরা তো রাজনৈতিক দলের সভায় বক্তৃতা করি না। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘সাংবাদিকরা যেখানে বসা থাকবে তুই সেখানে থাকবি। তোকে দেখলেই মানুষ চাইবে। তুই বক্তৃতা করিস।’ একজন মানুষ প্রায় ৩৩ মাস কারাভ্যন্তরে বন্দি, অথচ তিনি যা বলেছেন অক্ষরে অক্ষরে তা-ই হয়েছে। জনসভা শুরু হলো, আমরা ছাত্রসমাজ গেলাম, সাংবাদিকেরা যেখানে বসেন, তার কাছাকাছি থাকলাম। ডাক-এর সভাপতি ছিলেন নুরুল আমিন। সভামঞ্চ থেকে নুরুল আমিনের নাম প্রস্তাব করা হলে জনসভার মানুষ সে-নাম ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করল। মঞ্চ থেকে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ আমাকে মঞ্চে তুলে নিলেন। বঙ্গবন্ধুর ছবি বুকে ধারণ করে বলেছিলাম, সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের প্রিয় নেতা আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। উল্লেখ্য যে, আইয়ুব খান তখন সর্বদলীয় গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেছিলেন। প্রশ্ন উঠেছিল গোলটেবিল বৈঠকে যাওয়া হবে কি না। আমরা বলেছিলাম, ‘যাওয়া হবে। তবে নেতৃত্ব দেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিব।’ এই পরিস্থিতি সামনে রেখে জনতার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি ছাড়া আপনারা কি গোলটেবিল বৈঠক চান?’ লক্ষ লক্ষ মানুষ গগনবিদারী কণ্ঠে বলেছিল, ‘না, চাই না, চাই না।’ ইতোমধ্যে প্রিয় নেতাকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে নেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছিল। সেই বিষয়টিও জনতার সামনে তুলে ধরে প্রশ্ন রেখেছিলাম, ‘আপনারা কি শেখ মুজিবের প্যারোলে মুক্তি চান?’ মানুষ বলেছে, ‘না না, চাই না।’ তখন নেতৃবৃন্দকে আমরা বলেছিলাম, ‘নেতৃবৃন্দ, আপনারা যাবেন। কিন্তু প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে ছাড়া আপনারা গোলটেবিল বৈঠকে বসবেন না।’ এটি ছিল প্যারোলে মুক্তি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে যাওয়া-না-যাওয়া প্রশ্নে জনতার ম্যান্ডেট। বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে নেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা হয়েছিল। পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী কাজী সাহাবুদ্দিন, নেভাল চিফ এ আর খানসহ আরও অনেকেই এসেছিলেন। কিন্তু সে-সব প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে মুখ্য ও ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে পল্টনের মিটিংয়ে জনতার সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে বঙ্গমাতা বলেছিলেন, ‘মানুষ তোমার সম্পূর্ণ মুক্তি চায়। তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে, তোমাকে প্যারোলে মুক্তি দেবার জন্য। তুমি কোনোদিন প্যারোলে রাজি হবে না। বাংলার মানুষ তোমার প্যারোলে মুক্তি চায় না। বাংলার মানুষ তোমাকে ছাড়া গোলটেবিল বৈঠক চায় না। তোমার সম্পূর্ণভাবে মুক্তি না হলে প্যারোলে মুক্তির কোনো চেষ্টা যেন না হয়।’ বঙ্গবন্ধু নিজেও প্যারোলে মুক্তি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে যেতেন না। বঙ্গবন্ধুকে যখন প্রস্তাব দেওয়া হয়, তখন তিনি ঘৃণাভরে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ‘আমি মুক্ত মানুষ হিসেবেই গোলটেবিল বৈঠকে যাব।’ তার পর ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্টে আটকাবস্থায় সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করা হয়। সারা দেশে দাবানলের মতো আগুন জ্বলে ওঠে। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে পাকিস্তানি সেনারা বেয়নেট চার্জে নির্মমভাবে হত্যা করে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি রাখে। আমরা সিদ্ধান্ত নিই, সান্ধ্য আইন ভাঙব এবং শহরকে মিছিলের নগরীতে রূপান্তরিত করব। ২০ ফেব্রুয়ারি সমগ্র ঢাকা নগরীকে মশাল আর মিছিলের নগরীতে পরিণত করে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহারে বাধ্য করে, পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে পল্টনের জনসমুদ্রে প্রিয় নেতা শেখ মুজিবসহ আগরতলা মামলায় আটক সব রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে আমরা ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম প্রদান করি। জনরোষের ভয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টায় প্রিয় নেতাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে তাঁর বাসভবনে পৌঁছে দেওয়া হয়। দেশজুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়াদী উদ্যান) প্রিয় নেতাকে গণসংবর্ধনা জানিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম-তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল লাহোরে গিয়েছিলেন গোলটেবিল বৈঠকে। কিন্তু তাঁরা শর্তারোপ করেছিলেন, ‘আমাদের দলের নেতৃত্ব দেবেন শেখ মুজিবুর রহমান। যতক্ষণ তিনি না আসবেন, ততক্ষণ আমরা গোলটেবিল বৈঠকে বসব না।’ বঙ্গবন্ধুর জন্য গোলটেবিল বৈঠক অপেক্ষা করেছিল; ‘মুক্তমানব’ হিসেবেই বঙ্গবন্ধু সেখানে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং এটিই বাংলার মানুষ প্রত্যাশা করেছিল। গণঅভ্যুত্থানের সেই উত্তাল দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা ও বঙ্গমাতার অবদান স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে।
একটি কথা বার বার মনে হয়। একজন নেতা কত দূরদর্শী যে, তিনি সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে জানতেন। কোন সময় কোন কথা বলতে হবে এটা তার মতো ভালো জানতেন এমন মানুষ এই ক্ষুদ্র জীবনে দেখিনি। লক্ষ করেছি, বঙ্গবন্ধু জীবনে স্ববিরোধী বক্তব্য দেননি। একটি বক্তব্য দিয়ে পরে সেই বক্তব্য অস্বীকার করা বা বক্তব্যের মধ্যে পরস্পরবিরোধিতা তাঁর কোনোদিন হয়নি। যা তিনি বিশ্বাস করেছেন, ভেবেছেন, মনে করেছেন যে এটিই বাস্তবসম্মত, সেটিই বলেছেন সুচিন্তিতভাবে। একবার যা বলেছেন, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও আপোষহীন থেকেছেন। শ্রদ্ধেয়া বঙ্গমাতার কাছে শুনেছি, ’৭১-এর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক বক্তৃতার আগে ৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু অস্থিরভাবে পায়চারি করেছেন এবং ভেবেছেন কী বলবেন। বঙ্গমাতা বলেছিলেন, ‘তুমি এত চিন্তা করো কেন? সারা জীবন একটা লক্ষ্য নিয়ে সংগ্রাম করেছ, কারাগারে গিয়েছ, জেল খেটেছ, ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছ। তোমার বিশ্বাসী অন্তর থেকে যা ভালো মনে করো এই মিটিংয়ে তুমি তাই বলবা। দেখবা মানুষ সেটাই গ্রহণ করবে। তুমি এখন ঘুমাও।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর হৃদয়ে ধারিত গভীর বিশ্বাস থেকেই সেদিন বক্তৃতা করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রেরণা দিয়ে তিনি ছায়ার মতো বঙ্গবন্ধুর নিত্যসঙ্গী ছিলেন। ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বই দুটো লেখার পেছনেও রয়েছে বঙ্গমাতার অবদান। উনি বঙ্গবন্ধুকে বার বার অনুরোধ করেছেন, খাতাপত্র সরবরাহ করে বলেছেন যে, কারাগারে বসে তুমি এসব লেখো। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের প্রথম পৃষ্ঠার শুরুতেই বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।’” ‘আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু—আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’ বঙ্গমাতার অনুপ্রেরণায় তিনি লিখেছেন। সেদিনের সেই পাণ্ডুলিপি আজ বই আকারে দেশবাসীর হাতে তুলে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু কখনো জন্মদিন পালন করতেন না। এ সম্পর্কে ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থের ২০৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই—বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটাতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে।’ বঙ্গবন্ধু বঙ্গমাতাকে খুব ভালোবাসতেন, ভালো জানতেন ও সম্মানের চোখে দেখতেন। বঙ্গমাতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনে সুখ-দুঃখের সঙ্গী। জাতির পিতার জীবনের কঠিন দিনগুলোতে বঙ্গমাতাই আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ধরে রেখেছেন। তখন দুটো সংগঠন ছিল। একটি আওয়ামী লীগ, অপরটি ছাত্রলীগ। কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, যুবলীগসহ অন্যান্য সংগঠন পরে হয়েছে। আমরা যারা ছাত্রলীগ করতাম, কোনো কাজে বঙ্গমাতার সাথে দেখা করতে গেলে তিনি আমাদের বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছেন। কঠিন দুঃসময়ের মধ্যেও আর্থিক সাহায্য করেছেন। আমরা ৫ টাকা, ১০ টাকা, ১০০ টাকার কুপন নিয়ে মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতাম। এমন দিনও গেছে কেউ ১০০ টাকা দিলে আমরা তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ওই সময়েও বঙ্গমাতা সংগঠনের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আমাদের কর্মকাণ্ড সচল রেখেছেন। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর যেদিন দেশ শত্রুমুক্ত হলো সেদিন আমরা বিজয়ীর বেশে প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে এলাম। ১৮ ডিসেম্বর আমি এবং আব্দুর রাজ্জাক—আমরা দু’ভাই হেলিকপ্টারে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করি। চারদিকে ‘জয় বাংলা’ জয়ধ্বনির আনন্দ, ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না! প্রথমেই ছুটে গিয়েছিলাম শ্রদ্ধেয়া বঙ্গমাতা, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও শেখ রাসেলসহ বঙ্গবন্ধু পরিবার যেখানে বন্দি ছিলেন সেখানে। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন এবং মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর এডিসি ছিলেন এবং শেখ জামাল দেরাদুনে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গমাতাকে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায়নি। শেখ মুজিবের স্ত্রীকে বাসা ভাড়া দিলে বাড়িওয়ালাকে পাকিস্তান আর্মি ধরে নিয়ে যাবে। যদি-বা কষ্টে-সৃষ্টে পরিচয় গোপন করে বাসা ভাড়া পাওয়া গেছে, তা-ও আবার পরিচয় পাবার পর কয়েক ঘণ্টার নোটিশে সেই বাসা ছেড়ে দিতে হয়েছে। পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গমাতাকে ধানমণ্ডিস্থ ১৮ নম্বরের একটি বাড়িতে গৃহবন্দি করে রাখে। মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে বঙ্গমাতা কঠিন সময় অতিক্রম করেছেন।
দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী; তবু বঙ্গমাতা সরকারি বাসভবনে না, থেকেছেন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের অনাড়ম্বর বাসভবনে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দরজা ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। সর্বস্তরের মানুষ যাতায়াত করত। বঙ্গমাতা সবাইকেই হাসিমুখে গ্রহণ ও বরণ করতেন। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে দলের প্রতিটি নেতাকর্মীর খোঁজ নিতেন, সাধ্যমতো সহায়তা করতেন। স্বাধীনতার পর যখন আমি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব প্রতিদিন সকাল ৯টায় ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যেতাম, সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর সাথে গণভবনে। এরপর রাত ৯টায় বঙ্গবন্ধুকে ৩২ নম্বরের বাসভবনে পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফিরতাম। যখন বঙ্গমাতার বাসায় যেতাম, তখন তিনি আমাদের নিজ সন্তানের মতো যত্ন করতেন। বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুর জন্য স্বহস্তে রান্না করতেন। বঙ্গবন্ধুর সবকিছু গুছিয়ে রাখতেন। বঙ্গবন্ধু বঙ্গমাতাকে ‘রেণু’ বলে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ছিলেন আদর্শ দম্পতি, আদর্শ যুগল। ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রাপ্তির ঐতিহাসিক জনসভায় জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘তোমরা যারা রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে কারাগার থেকে আমাকে মুক্ত করেছো, যদি কোনদিন পারি নিজের বুকের রক্ত দিয়ে তোমাদের রক্তের ঋণ শোধ করে যাবো।’ তিনি একা রক্ত দেননি, সপরিবারে রক্ত দিয়ে সেই রক্তের ঋণ শোধ করে গেছেন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে ঘাতকের বুলেট যখন জাতির পিতার বক্ষ বিদীর্ণ করেছিল, সে-সময় চিৎকার করে ঘাতকের দলকে বঙ্গমাতা বলেছিলেন তাঁকেও মেরে ফেলতে। জীবনসঙ্গীর মরণকালে চিরকালের জন্য তাঁর সহযাত্রী হয়েছেন। জাতির পিতা ও বঙ্গমাতা বাংলার মানুষকে খুব ভালোবাসতেন। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাথে তাঁদের এই অকৃত্রিম সৃষ্টিশীল ভালোবাসা অম্লান হয়ে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। জাতির পিতা ও বঙ্গমাতা সম্পর্কে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়—
‘পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি